Skip to content

আদালতের রায়: শিক্ষার্থীদের বৈবাহিক অবস্থার তথ্য বাধ্যতামূলক নয়

বেনার নিউজ:

দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না বলে বৃহস্পতিবার রায় দিয়েছে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত।

বিবাহিত নন, আবার স্বামী পরিত্যক্তাও নন-এমন এক ধর্ষণের শিকার অবিবাহিতা মাকে রাজশাহীর নার্সিং কলেজে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর দায়ের করা রিট আবেদন নিষ্পত্তিকালে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ আদালতের বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘মেয়েটি এখন কী করবে?’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে রাজশাহীতে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর গর্ভবতী একজন মেয়ের অসহায়ত্ব তুলে ধরা হয়।

দশম শ্রেণির ছাত্রীটি ২০১৩ সালের ৬ জুন ধর্ষণের শিকার হন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সালিশে ধর্ষকের সংগে মেয়েটির বিয়ের দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি ধর্ষণের বিষয়টি অস্বীকার করেন। মেয়েটির পরিবার মামলা করতে ব্যর্থ হয়।

কয়েক মাস পর জানা যায়, মেয়েটি গর্ভবতী। অভিযুক্ত যুবকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়। আসামিকে আটক করে পুলিশ।

মেয়েটিকে ‘মহিলা সহায়তা কর্মসূচি’র রাজশাহী বিভাগীয় আবাসনকেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখান থেকেই মেয়েটি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ করেন।

এই অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই মেয়েটি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।

সন্তানের পিতৃত্ব প্রমাণের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয় যে অভিযুক্ত ধর্ষকই ওই সন্তানের জনক। ২০১৭ সালের ৩০ মে আদালতের রায়ে ধর্ষকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তাকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

আইনজীবীর তথ্য অনুযায়ী, আবাসনকেন্দ্র থেকেই থেকে এইচএসসি পরীক্ষাও অংশ নিয়ে মেয়েটি উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি একটি নার্সিং কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করলে সেখানে তাঁর বৈবাহিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

কলেজের নিয়ম অনুসারে তিনি বিবাহিত অথবা স্বামী পরিত্যক্তা-যে কোনো একটি লিখতে হবে। তিনি এই দুই শ্রেণির কোনটির অন্তর্ভুক্ত নন। আবার অবিবাহিতা হলে তিনি মা হলেন কীভাবে এমন প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। ফলে তিনি নার্সিং কলেজের ফরমই পূরণ করতে পারছিলেন না।

এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন আইনজীবী অনিক আর. খান।

২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের রুলে সরকারের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈবাহিক অবস্থা জানতে চাওয়া কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না। 

একই সাথে বলা হয়, কেন এ বিষয়ে একটি সঠিক নীতিমালা করা হবে না। মেয়েটিকে নার্সিং কলেজে ভর্তির আদেশও দেয়া হয়।

আইনজীবী অনিক আর. খান জানান, ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণা করছেন।

যুগান্তকারী রায়

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আইনজীবী অনিক বলেন, এটি একটি যুগান্তকারী রায়। এই রায়ের ফলে এখন থেকে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থীকে তাঁর বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না।

অনিক আরও বলেন, “আমি আনন্দিত এই জন্য যে শিক্ষার্থীদের ওপর, বিশেষ করে আমাদের দেশের নারীদের ওপর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে বিভিন্ন ধরনের শর্ত আরোপ করে থাকে এই রায়ের ফলে এই ধরনের কাজ বন্ধ হবে।”

অ্যাডভোকেট অনিক বলেন, “আমি জানি না কী কারণে এবং কবে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় এবং বৈষম্য সৃষ্টিকারী ব্যবস্থা চালু করেছে। এটি অনেক আগেই বাতিল হওয়া উচিত ছিল।’’

আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের মানবাধিকার কর্মী এবং নারী শিক্ষার্থীরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষ ও রহমতুন্নেছা হলের আবাসিক ছাত্রী সিরাজুম মুনিরা সঞ্চিতা বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দিতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা যাবে না—এ সম্পর্কে আদালত যে রায় আজকে দিয়েছে সেটিকে আমি সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করি।”

মুনিরা বলেন, “একজন নাগরিক তাঁর বৈবাহিক অবস্থা নির্বিশেষে শিক্ষা নেয়ার যোগ্য। কারণ শিক্ষা সবার মৌলিক অধিকার। আমি বিবাহিত অথবা অবিবাহিত এব্যাপারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জানার কোনো প্রয়োজন নেই বলে আমি মনে করি।”

এর আগে গত ২৪ জানুয়ারি শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীর তথ্য সংক্রান্ত ফরম (এসআইএফ) সংশোধনের মাধ্যমে ‘বাবা’ অথবা ‘মা’ অথবা ‘আইনগত অভিভাবকের’ নাম—যুক্ত করতে নির্দেশ দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট।

এর ফলে অভিভাবকের ঘরে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবক—এই তিন বিকল্পের যেকোনো একটি উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা ফরম পূরণ করতে পারবে।

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার (এসএসসি) পর্যায়ে বাবার নাম না দিয়ে মায়ের নাম দিয়ে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণের সুযোগ নিয়ে ১৪ বছর আগে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “একটি স্বাধীন দেশে এতদিন কেন এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি তা আমার বোধগম্য নয়। আলোচ্য দুটি রায়ের মাধ্যমে আদালত নারী বৈষম্য সৃষ্টি করা দীর্ঘদিনের চর্চাগুলোকে অবৈধ বলেছেন। এসব পরিবর্তন অনেক আগেই আসা উচিত ছিল।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *