<![CDATA[
‘আমার বাবায় কই? আমার বাবারে ছাড়া আমি কেমনে বাঁচুমরে। ওই আমার বাবারে আমার বুকে আইনা দেও। আমার সোনারে ছাড়া আমি কেমনে থাকুম। আমার বুকের মানিককে আমার বুকে ফিরাইয়া আইনা দেও।’ এভাবেই চিৎকার ও আহাজারি করে কাঁদছিলেন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার খিদিরপুর গ্রামের মৃত ফাইয়ানের মা শান্তা আক্তার।
শনিবার (০৫ আগস্ট) মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার রসকাঠি এলাকার ট্রলার ডুবির ঘটনায় সন্তান হারিয়ে তিনি এখন পাগল প্রায়।
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের খিদিরপুর গ্রামে চলছে মাতম। স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর সবাই। পুরো গ্রামের লোকজন শোকাহত হয়ে পড়েছে। সবার মুখের হাসি যেন মিলিয়ে গেছে তালতলা-ডহরি খালে। শোক যন্ত্রণা যেন সইতে পারছে না গ্রামটির জাহাঙ্গীর আলম। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হারিয়ে তিনি এখন শোকে পাথর। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন তিনি। বেঁচে আছে মাদ্রাসা পড়ুয়া বড় সন্তান রাফিকুল ইসলাম (১৩)। শোকে পাথর জাহাঙ্গীর। কথা বলার ভাষা নেই তার। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি। অঝোরে কেঁদে চলেছেন তিনি।
বাড়ির উঠানে প্রতিবেশীদের ভিড়। সান্ত্বনা দেয়ারও ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তারা। কী বলে সান্ত্বনা দেবেন সেই কথাও যেন বলতে পারছেন না কেউ। গ্রামটির প্রায় ঘরেই এখন মাতম। কেউ সন্তান, কেউ স্ত্রী হারিয়ে এখন শোকে কাতর। আর গ্রামবাসী কাতর স্বজনদের আহাজারিতে। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এপি আক্তার ও দুই ছেলে সাকিবুল (০৬) সাজিবুলকে (০৪) হারানোর আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
আরও পড়ুন: মুন্সিগঞ্জে ট্রলারডুবি, উদ্ধারে নৌবাহিনীর ডুবুরি দল
রোববার (০৭ আগস্ট) মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার লতব্দী ইউনিয়নের খিদিরপুর গ্রামে গিয়ে এমনই চিত্র দেখা যায়। শনিবার রাতে লৌহজংয়ের খালে ট্রলার ডুবির ঘটনায় ৭ জনের মৃত্যুতে গ্রামটিতে চলছে মাতম।
জাহাঙ্গীর পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী। তিন সন্তানের বাবা জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে রাকিবুল ইসলাম স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। ছোট দুই ছেলে সাকিবুল, সাজিবুল আর স্ত্রী এপি আক্তারকে নিয়ে শনিবার আনন্দভ্রমণে পদ্মা ব্রিজ দেখতে যান। কিন্তু জাহাঙ্গীর ফিরে এলেও আসতে পারেনি স্ত্রী ও দুই ছেলে। সাকিবুল খিদিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্র।
ওই প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক তরকিুল ইসলাম বলেন, সাকিবুল খুবই মেধাবী ছাত্র ও শান্ত প্রকৃতির ছেলে। আচার আচরণও খুব ভালো ছিল। এ বছর বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। ওর এই অকাল মৃত্যুতে ছাত্র-শিক্ষক সবাই শোকাহত।
সরেজমিনে গিয়ে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দেখা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। কিছু বলতে গেলেই কেঁদে ওঠেন, যেন অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি।
মৃত এপি আক্তাররের চাচাতো ভাই পুলিশ পরিদর্শক (ঢাকা ডিএমপি) মো. আরশাদ আকাশ বলেন, ‘ভাই বলার ভাষা নেই, এ দুর্ঘটনায় আমার ৪ মাস বয়সী ভাতিজিও মারা গেছে। দুর্ঘটনায় শিকার সবাই আমার পরিবারের লোক। এ শোক কাটিয়ে উঠতে পারব কি না জানি না, তবে প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করব অবৈধ নৌযান চলাচল যেন খুব শিগগিরই বন্ধের ব্যবস্থা নেয়। ওই খালে এর আগেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, মানুষ হতাহত হয়েছে।’
এদিকে রোববার সকাল ৯টায় খিদিরপুর জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে মরদেহ খিদিরপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আরও পড়ুন: মুন্সীগঞ্জে ট্রলারডুবি, নিহত ৮ জনের পরিচয় মিলেছে
সিরাজদিখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম তানভীর বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। আমরা মৃতের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছি এবং আজ বাদ জোহর সিরাজদিখান মডেল মসজিদে মৃতদের স্মরণে মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করেছিলাম।’
প্রসঙ্গত শনিবারের ট্রলার ডুবিতে ওই গ্রামের ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছে ৩ জন।
তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে গঠিত তদন্ত কমিটি কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) শারমিন আরাকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৩ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। শারমিন আরার নেতৃত্বাধীন কমিটির রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সংশ্লিষ্টদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন।
তুরান-নাভার বাবা দেশের পথে
নিখোঁজ কয়রাখোলা গ্রামের আরিফ শেখ পুত্র তুরান আহমেদ (৮) ও কন্যা নাভা আক্তার (৫)। পিকনিকের ট্রলারে থাকা তুরান ও নাভার মা সমাপ্তি বেগম তীরে উঠতে পারেলও দুই সন্তানকে রক্ষা করতে পারেননি। সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাবা আরিফ শেখ খবর পেয়ে পাগল প্রায়। রোববার দিবাগত মধ্যরাতে তার ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা রয়েছে।
সমাপ্তি বেগমের বাবার বাড়ি খিদিরপুর গ্রামে। তাই বাবার বাড়ির স্বজনের সঙ্গে পদ্মা সেতু ঘুরতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে পরিণত হয়েছে। সমাপ্তি বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। আর গ্রামটির একই পরিবারের চার জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। আরও নিখোঁজ রয়েছে একজন। এই পরিবারকে বুকফাটা আর্তনাদ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এপি আক্তার (৩০) ও তার দুই পুত্র সাকিবুল (০৮), রাকিবুল( ১২) এবং বড় বোন পপি আক্তারের (৩৫) লাশ উদ্ধার হয়েছে। তবে এপির ভাতিজা মাহিমের সন্ধান মেলেনি। নিখোঁজ তিন শিশুকে উদ্ধারের যৌথ অভিযান সন্ধ্যা পর্যন্ত চলমান ছিল। সোমবার সকাল থেকে আবার শুরু হবে।
এখনও কেউ গ্রেফতার নেই
মুন্সীগঞ্জর পদ্মার শাখা নদীতে ট্রলার ডুবির ঘটনায় বাল্কহেটের মালিক ও চালকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে লৌহজং থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী মো. রুবেল শেখ। রুবেলের সন্তানের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। তার আপন দুই বোন এবং দুই ভাগ্নে মারা গেছে। আলোচিত এ ঘটনার অপরাধীদের পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। একই উদ্দেশ্যে বেপরোয়া গতিতে জলযান চালিয়ে মৃত্যু ঘটানো, জানমালের ক্ষতিকরণ ও সহায়তা করার অপরাধে ২৮০/৩০৪ (খ)/ ৩৩৭/ ৩৩৮/ ৪২৭/ ১০৯/ ৩৪ ধারায় মামলাটি রুজু হয়। থানায় মামলাটি হলেও জলপথে দুর্ঘটনার কারণে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে মাওয়া নৌ পুলিশ।
বাল্কহেডটির অজ্ঞাত মালিককে প্রধান আসামি করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রধান আসামি করা হয়েছে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রলারে জাহিদ শিকদার ও তৃতীয় প্রধান আসামি করা হয়েছে ট্রলারটির পাপ্পু চোকদার। এছাড়া বাল্কহেডটির অজ্ঞাত সুকানি (চালক) এবং অজ্ঞাত নামা ২/৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।
লৌহজং থানার ওসি খন্দকার ইমাম হোসেন জানান, রবিবার বিকেলে সাড়ে ৩টার দিকে লৌহজং থানায় করা মামলাটি করা হয়।
আরও পড়ুন: পথ হারিয়ে অষ্টগ্রাম হাওড়ে ঘুরছিল শতাধিক পর্যটকবাহী নৌকা, পরে উদ্ধার
শনিবার রাত ৮টা ৫ মিনিটের দিকে ৪৬ জন যাত্রী নিয়ে লৌহজং উপজেলার রসকাটি এলাকায় বাল্কহেডের ধাক্কায় ট্রলারটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় সাতজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনই মামলার বাদীর স্বজন। তাঁরা হলেন পপি আক্তার (২৮), এপি আক্তার (২৮) ও পপির দুই ছেলে সাকিবুল (১০), সজিবুল (৪)। মৃত অন্যরা হলেন মোকছেদা বেগম (৪০), হুমায়ারা (৫ মাস), ফারিয়ান (৮)। এ ছাড়া নিখোঁজ তিন শিশু। তারা হলো- ভাই বোন তুরান (৮) ও নাভা (৫) এবং মাহির (১১) । এর মধ্যে মাহির মামলার বাদী রুবেল শেখের ছেলে।
]]>