<![CDATA[
জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে পাকিস্তানের রাজনীতি। দেশটির অর্থনীতি এমনিতেই এখন তলানিতে। রাজনীতি সংঘাতপূর্ণ। সামরিক বাহিনী অবিশ্বাসযোগ্য। সব মিলিয়ে দেশটি কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। এর মধ্যে তাদের জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসছে দ্রুত। সুতরাং নির্বাচনী ষড়যন্ত্রে বিলম্ব কেন! শেষ পর্যন্ত সেটাও শুরু হয়েছে।
এমন কোনো সমস্যার কথা বলা যাবে না, যেটা পাকিস্তানের নেই। মারামারি, সংঘাত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, নির্বাচনী ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক উন্মাদনা, সবই পাকিস্তান ধারণ এবং লালন করে। কারণ পাকিস্তান সংলাপ, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং শান্তিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে সহনশীলতার বড় অভাব সেখানে।
পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ৩০ বছরের কম। তারা যদি উচ্চশিক্ষার সমান সুযোগ না পায়, তাহলে সমাজে একটা অসম প্রভাব পড়বে। সেটাই স্বাভাবিক। যাই হোক, পাকিস্তানের নীরব এবং অসম শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে একটা ক্ষোভের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ফলে অসহিষ্ণুতা থেকে তারা উগ্রপন্থার দিকেও ধাবিত হচ্ছে। পাকিস্তানে আন্তঃসাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের (লিঙ্গ, জাতিগত এবং ধর্মীয়) ন্যায়সঙ্গত অন্তর্ভুক্তির অভাব রয়েছে বড় রকমের।
সমাজের দীর্ঘ অমীমাংসিত ক্ষোভ ও অভিযোগের সমাধান বের করার জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ভরযোগ্যভাবে কাজ করতে পারেনি। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর দেশটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখেছে। যাই হোক, ২০২৩ সালে প্রত্যাশিত নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সাথে সাথে এটি গভীর অভ্যন্তরীণ মেরুকরণের সাথে একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তান। ইতোমধ্যে, ২০২২ সালে পাকিস্তানজুড়ে বিধ্বংসী বন্যায় ক্ষতি হয়েছে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের। এতে দেশের কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুন: কারাগারে ‘খেতে দেয়া হচ্ছে না’ ইমরান খানকে
গত ৩১ জুলাই উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে একটি ইসলামি দল আয়োজিত রাজনৈতিক সম্মেলনে আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ৫৪ জন নিহত হয়। এটি একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা! পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এর পেছনে রয়েছে আইএসআই-এর হাত। এসব কিছুতে কি পাকিস্তানের হুঁশ হয়েছে?
এরইমধ্যে তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ইসলামাবাদের ট্রায়াল কোর্ট। জরিমানাও করা হয়েছে—এক লাখ রুপি। যদিও ইমরান খান সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তার গ্রেফতারের আগে রেকর্ড করা একটি ভিডিওতে এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স-এ’ একটি পোস্টে ইমরান খান তার সমর্থকদের রাস্তায় নামতে আহ্বান করেন জোর প্রতিবাদে জানানোর জন্য। ‘আমার একটাই অনুরোধ, একটাই আবেদন আপনাদের কাছে। আপনারা আর বাড়ির ভেতর চুপচাপ বসে থাকবেন না। আমি যে সংগ্রাম করছি, তা আমার নিজের জন্য নয়, এটা আমার জাতির জন্য, আপনাদের জন্য। আপনার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য। আপনি যদি আপনার অধিকারের জন্য না দাঁড়ান, তবে আপনি ক্রীতদাসের জীবনযাপন করবেন সারা জীবন,’ ইমরান বলেন।
ইমরান খানের বয়স এখন ৭০। ক্রিকেট জগত থেকে রাজনীতিতে এসেছেন তিনি। ফলে তরুণদের মাঝে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। ইমরানের এই গ্রেফতার নিঃসন্দেহে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। কিন্তু এটা দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর সাথে তার সম্পর্কের একটা ছন্দপতন ঘটাবে নিঃসন্দেহে। এসবের মূলে রয়েছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ও সামরিক সংস্থার প্রতি ক্রমাগত ক্রোধ এবং আমেরিকাবিরোধী মনোভাব প্রকাশ।
তার বিরুদ্ধে এ রকম রায়ের অর্থ হল, তিনি আর আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না।
দুর্ভাগ্যজনক
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের সাবেক অনেক প্রধানমন্ত্রীর মতো ইমরানকেও আসন্ন জাতীয় নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এ পদক্ষেপ নিয়েছে ক্ষমতাসীন শাহবাজ প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী। এটাকে তারা দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন।
এ নিয়ে সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক শাহজাইব খানজাদা বলেন, এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক বিষয় যে, আরেকজন প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনের আগে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, রায়টি খুব তাড়াহুড়ো করে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি পূর্বপরিকল্পিত।
অনেক সমালোচক যুক্তি দেন যে ইমরান খান ক্ষমতায় উত্থানের সময় সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ নিয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর সাথে তার দলের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বিবিসিকে বলেন যে তার পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ‘একমাত্র দল, যা সামরিক স্বৈরশাসকদের দ্বারা তৈরি নয়। আর এ কারণেই দলটি ভেঙে দেওয়ার অভিযান চালানো হয়েছে।’
খান ২০১৮ সালে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। মাত্র চার বছরের কম সময়ের মধ্যে, অর্থাৎ গত বছর, সংসদীয় অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি।
আরও পড়ুন: ইমরান খানের গ্রেফতার দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়: যুক্তরাষ্ট্র
জাতীয় পরিষদ
এরপর আসছে ৯ আগস্ট, ২০২৩। এ আরেক অনিশ্চয়তার যাত্রা। তখন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভির কাছে তিনি জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করবেন। জাতীয় পরিষদের এই অকাল বিলুপ্তি পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনকে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ৯০ দিন সময় দেবে। যার অর্থ হল—এ বছরের ৯ নভেম্বরের মধ্যে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
সরকারের মিত্ররা তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর জন্য তাদের প্রার্থীদের বিষয়ে একমত বলে মনে হচ্ছে না আপাতদৃষ্টিতে।আসন্ন সাধারণ নির্বাচনগুলো দেশের জন্য একটি ব্রেকআউট পয়েন্ট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পিটিআই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার কারণে এখন তাদের একটা ভিন্ন যাত্রা শুরু হলো। এত কিছুর মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে আসছে যে, পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন আদৌ কি সময়মতো হবে কিনা?
নির্বাচন কি পিছিয়ে যাবে?
গত শুক্রবার জিও নিউজের সাথে আলাপকালে, পাকিস্তানের প্রাক্তন সচিব ইসিপি কানওয়ার দিলশাদ বলেছিলেন যে, সিসিআই যদি ২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুমোদন করে, তবে ২০২৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, না হয় ‘নির্বাচন পিছিয়ে যাবে চার মাস।’
পাকিস্তান এখন একটা বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। দেশটা ভেঙে না পড়লেও ব্যাপক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা দৃশ্যমান। ভবিষ্যৎ অন্ধকার নাহলেও উজ্জ্বল নয়।
]]>