<![CDATA[
বিশ্বজুড়ে জলবায়ুগত যে চ্যালেঞ্জ, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শক্তি বা জ্বালানি। আবার এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমাধানের চাবিকাঠি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান নিয়ামক জীবাশ্ম জ্বালানির বিপরীতে একটি টেকসই ও বিকল্প উৎস হিসেবে এরই মধ্যে প্রমাণিত গ্রিন এনার্জি বা সবুজ জ্বালানি।
বিশ্বের বহু দেশ সবুজ জ্বালানির ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এছাড়া অনেক দেশই কার্বন নিঃসরণ কমানো ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবস্থা রূপায়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের লাগাম টানার গুরুত্ব স্বীকার করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবুজ জ্বালানি
কোনো একটি জায়গায় কয়েক বছরের আবহাওয়ার গড়-পড়তা ধরণকে বলা হয় জলবায়ু। আবহাওয়ার সেই চেনাজানা স্বাভাবিক ধরণ বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের এক চরম বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে গ্রিনহাউস ইফেক্ট।
শক্তি ও তাপ উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেনসহ নানা ধরণের ক্ষতিকারক গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের একটি বড় অংশ পৃথিবীকে কম্বলের মতো ঘিরে রয়েছে। এই গ্যাসগুলোই সূর্যের তাপ আটকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে উৎতপ্ত করে চলেছে। অর্থাৎ পৃথিবী দিনদিন গরম হয়ে পড়ছে এবং এর ফলে পরিবেশ ও প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করছে।
কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানিগুলো বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক, যা বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ৭৫ শতাংশের বেশি এবং সমস্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের প্রায় ৯০ শতাংশের জন্য দায়ী।
আরও পড়ুন: নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বড় বিনিয়োগের পথে ভারত
জলবায়ু পরিবর্তনের নানা নেতিবাচক প্রভাব এরইমধ্যে বিশ্ব দেখতে শুরু করেছে। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে উত্তর মেরুর জমাট বাধা বরফ ও হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। এতে সাগরের উচ্চতা বেড়ে উপকূলের নিচু এলাকাগুলো ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন যদি এখনই ঠেকানো না যায় বা প্রতিরোধ না করা যায়, তাহলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলও পানির নিচে নিমজ্জিত হবে।
ভয়ানক এসব পরিস্থিতি এখনও এড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বক্তব্য পরিষ্কার: জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব এড়াতে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিসহাউজ গ্যাস বা কার্বন নির্গমন প্রায় অর্ধেক কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট জিরো’ তথা শূন্যে পৌঁছাতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতার অবসান ঘটাতে হবে এবং সেই সঙ্গে শক্তি বা জ্বালানির বিকল্প উৎসগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। গ্রিন এনার্জি বা সবুজ জ্বালানি এক্ষেত্রে একটি ভালো ও টেকসই বিকল্প হয়ে উঠছে।
বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত ৮০ শতাংশের বেশি শক্তির উৎস জীবাশ্ম জ্বালানি। কিন্তু জ্বালানির পরিচ্ছন্ন উৎসগুলোও অগ্রগতি অর্জন করছে। বর্তমানে প্রায় ২৯ শতাংশ বিদ্যুৎ আসছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে।
গ্রিন এনার্জি বা সবুজ জ্বালানি কী
সবুজ জ্বালানি হলো যেকোনো ধরনের শক্তি যা সূর্যালোক, বাতাস বা পানির মতো প্রাকৃতিক উৎসগুলো থেকে উৎপন্ন হয়। এটা নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো থেকেই পাওয়া যায়, যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সবুজ জ্বালানির মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
শক্তির উৎস হিসেবে সবুজ জ্বালানি সোলার প্যানেল বা সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি, বায়োমাস ও জলবিদ্যুৎতের মতো প্রযুক্তি থেকে আসে। এই প্রযুক্তিগুলোর প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে কাজ করে। যেমন সোলার বা সৌর প্যানেল যা সূর্য থেকে শক্তি গ্রহণ করে। আবার টারবাইন বায়ু ব্যবহার করে বা পানির প্রবাহ ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করা যায়।
সবুজ জ্বালানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউরোপ
জীবাশ্ম জ্বালানি এড়িয়ে একটি টেকসই বিকল্প হিসেবে বিশ্বের বহু দেশে এরইমধ্যে উল্লেখযোগ্য গতি অর্জন করেছে সবুজ জ্বালানি বা নবায়নযোগ্য শক্তি। কার্বন নিঃসরণে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও এক্ষেত্রে নেতৃত্বের অবস্থানে রয়েছে ইউরোপ।
উত্তর গোলার্ধের এই মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশের প্রয়োজনীয় জ্বালানির বেশিরভাগই আসছে সবুজ জ্বালানি উৎস থেকে। তবে এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোও খুব একটা পিছিয়ে নেই।
আমাদের নিজেদের স্বার্থেই দ্রুত নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে যাওয়া প্রয়োজন- ইউরোপ অনেক আগেই বিষয়টি উপলদ্ধি করতে পেরেছে। সেই উপলব্ধি থেকেই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে মুখ ফিরিয়ে সবুজ জ্বালানির সর্বাত্মক ব্যবহারে কাজ শুরু করেছে ইউরোপীয় দেশগুলো এবং এরইমধ্যে তারা অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য বাংলাদেশের
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবশেষ তথ্য-উপাত্ত ও প্রতিবেদন বলছে, আইসল্যান্ড, সুইডেন, স্কটল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক ও নরওয়ের মতো দেশগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়াইজভোটারের ‘রিনিয়েবল এনার্জি বাই কাউন্ট্রি’ শীর্ষ এক রিপোর্ট মতে, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৭২টি দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি শুরু করেছে। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারে ইউরোপে শীর্ষস্থানে রয়েছে আইসল্যান্ড। দেশটি বর্তমানে তার জ্বালানি চাহিদার ৮৬ দশমিক ৮৭ শতাংশই নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস থেকে উৎপাদন করছে।
৭১ দশমিক ৫৬ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে। আর নিজেদের জ্বালানি চাহিদার অর্ধেক তথা ৫০ দশমিক ৯২ শতাংশ পূরণ করছে সুইডেন। এছাড়া ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, কলম্বিয়া, পর্তুগাল ও ক্রোয়েশিয়াসহ ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের জ্বালানি চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশই নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস থেকে আসছে।
ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোও এক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উল্লেখযোগ্য দেশের তালিকায় এশিয়ার চীন, ভারত, শ্রিলঙ্কা, জাপান ও ফিলিপিন্সের মতো দেশগুলোও রয়েছে। তালিকায় এশিয়ার কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। তবে শেষের দিকে।
সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারতের চেয়ে এগিয়ে চীন
বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। এশিয়া মহাদেশে কার্বন নিঃসরণে চীনের পরে শীর্ষস্থানে আছে ভারত। তবে দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। নবায়নযোগ্য বা সবুজ জ্বালানির প্রতি ঝুঁকছে দেশগুলো। এরইমধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছে তারা। এক্ষেত্রে ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন।
ওয়াইজভোটারের প্রতিবেদন মতে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ পূরণ করছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস থেকে। ভারত ও রাশিয়া যথাক্রমে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ ও ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। অন্যদিকে নিজেদের চাহিদার ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশই সবুজ জ্বালানি উৎস থেকে উৎপাদন ও ব্যবহার করছে চীন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র
সবুজ জ্বালানি নিয়ে বিবিসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন মতে, চীনে বায়ু ও সৌর শক্তির উৎপাদন ও ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা বিশ্বে যে গতিতে কার্বন নির্গমন বাড়ছে, তা সীমিত করতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, চীনে যে গতিতে সোলার প্যানেল বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক সক্ষমতাকে ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি করবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চীন ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিন এনার্জি বা সবুজ জ্বালানি উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর আগেই ছাড়িয়ে যাবে।
সবুজ জ্বালানির পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার। এরইমধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প চালু হয়েছে।
২০০৮ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি তৈরি হয়। ওই নীতি অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। সেটা অর্জন করা সম্ভব না হলেও নতুন পরিকল্পনাগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে।
তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন খরচ, বিশেষ করে সৌর বিদ্যুতের, সাম্প্রতিক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) নথিতেই এ তথ্য উঠে এসেছে। নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এখনও দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক শতাংশেরও কম।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, সম্প্রতি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানির সময় দেয়া নথিতে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে শূন্য দশমিক ০৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে।
]]>