Skip to content

নিঃসঙ্গতা ও ঠিকানাহীন সমাজ | মুক্তকথা

নিঃসঙ্গতা ও ঠিকানাহীন সমাজ | মুক্তকথা

<![CDATA[

রাষ্ট্র, সমাজ আর পরিবারে কাঠামোই একটি মানুষকে নিঃসঙ্গ করে দেয়। নিঃসঙ্গ মানুষের যে একটি পোশাকি ঠিকানা থাকে না তা নয়। কিন্তু বাস্তবে তারা ঠিকানাবিহীন। আসলে নিঃসঙ্গতা এক ধরনের ঠিকানাহীনতা। সমাজে নিঃসঙ্গতা যত বাড়বে সেই সমাজ ততই ঠিকানাবিহীন হবে।

আর এই ধরনের সমাজের পরিণতি খুবই করুণ। ইট-পাথরের ভবন থাকবে কিন্তু মানুষ থাকবে না। মানুষ থাকবে কিন্তু প্রাণ থাকবে না। তারপরও যারা আবেগী হবেন তারা হয়তো হবেন আত্মঘাতী। অথবা লাশ পড়ে থাকবে ঘরে কেউ খোঁজও জানবে না। নাকে যখন পঁচা দুর্গন্ধ লাগবে তখন পুলিশে খবর দেবে। বেজে উঠবে ৯৯৯। কিন্তু দরজা খোলার লোক থাকবে না। দরজা ভেঙেই ভেতরে ঢুকতে হবে।

বয়স্কদের এই নিঃসঙ্গতার খবর আমরা মাঝে মধ্যে তাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পায়। কিন্তু এখনো যা আমরা অনুভব করতে পারছি না তা হলো শিশুর নিঃসঙ্গতা। একটি নিঃসঙ্গ প্রজন্ম মানুষের সান্নিধ্য ছাড়া ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠছে। আমরা এর পরিণতি আরও কিছুদিন পরে হয়তো দেখতে পাব। আর এরইমধ্যে তরুণদের ওপরে এই নিঃসঙ্গতার প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

ঘরে পড়ে থাকে লাশ:
গত ৭ জুলাই ঢাকার মগবাজার এলাকার একটি ফ্ল্যাটের সাত তলায় পুলিশ দরজা ভেঙে ইকবাল উদ্দিন নামে এক চিকিৎসকের গলিত লাশ তার নিজের বাসা থেকে উদ্ধার করে। তার দুই ছেলে মেয়ে এবং স্ত্রী দেশের বাইরে থাকেন। তিনি অসুস্থ অবস্থায় একাই ওই বাসায় থাকতেন। আত্মীয় স্বজনের সাথে ফোনেই যোগাযোগ হতো। পুলিশ ৯৯৯-এ কল পেয়ে তার লাশ উদ্ধার করে। উদ্ধারের কয়েকদিন আগে মারা গেলেও কেউ জানত না। তার লাশ পঁচে গন্ধ বের হচ্ছিল।

গত বছরের ১৭ এপ্রিল উত্তরার বাসা থেকে পুলিশ অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে। এই খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও একলা তার ফ্লাটে থাকতেন।

চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর আবু মোহসিন খান চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তার ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে ফেসবুক লাইভে মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তিনিও নিঃসঙ্গ ছিলেন। ঢাকা শহরে গত কয়েক বছরে নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মহত্যা বা একাকি বাসায় মারা যাওয়ার পর লাশ কয়েকদিন পর উদ্ধারের আরও কিছু ঘটনা আছে।

এটা যে শুধু বাংলাদেশে তা নয়। বরং উন্নত বিশ্বে এই নিঃসঙ্গতা আরও বেশি। শিল্প বিপ্লব এবং আধুনিকতা এর প্রধান কারণ। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালির মারিলেনা বেরেতা নামে এক বৃদ্ধ নারীর লাশ উদ্ধার করা হয় তার বাড়ি থেকে মৃত্যুর দুই বছর পর। তিনি চেয়ারে বসা অবস্থায় মারা যান। আর তার লাশটিও দুই বছর ওই চেয়ারেই ছিল। তার বাড়ির একটি গাছ ভেঙে পড়ায় স্থানীরা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। তারা এসে তার মরদেহ দেখতে পায়। এই ঘটনা পশ্চিমা বিশ্বকে ব্যাপক নাড়া দেয়। কিন্তু বাংলাদেশেও তা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এটার প্রধান কারণ নগর জীবনের ব্যস্ততা এবং যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া।

আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগকেও বদলাতে হবে

কোন পথে যাচ্ছি আমরা:
এ নিয়ে আমি সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বার বার কথা বলেছি। তাদের কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করেছি নিঃসঙ্গতার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট। তাদের কথা, বাংলাদেশে গ্রামে এখনো একাকিত্বের চাপ তেমন নেই। পারিবারিক বন্ধন এখনো ততটা আলগা হয়ে যায়নি সেখানে। যদি তাই হতো তাহলে এত মানুষ পথের কষ্ট আর বাধা উপেক্ষা করে পরিবারের লোকজনের সাথে ঈদ বা উৎসব আয়োজনে অংশ নিতে গ্রামে ছুটতো না। তারপরও শহুরে সমাজ এবং শিক্ষিত ও বিত্তশালীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা আতঙ্কজনক।

কৃষি নির্ভরতা যত কমছে ততই এই বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। শিল্প নির্ভরতা ভ্যালু অ্যাডিশন বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার শহরে যে কোনো কাজের ভ্যালু অ্যাডিশন বেশি। প্রতিযোগিতাও বেশি। এটা শহুরে মানুষকে বিচ্ছিন্ন এবং পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী করছে। এটা পরিবারেও ঘটছে। এটাই শহুরে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করছে। নিজের স্বার্থ ও প্রয়োজন ছাড়া অন্যের সাথে যোগাযোগ কমে যাচ্ছে।

বিশ্বে কোথায় কী হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। আমাদের এই জনপদের সংস্কৃতি হলো ঐক্যের সংস্কৃতি, একসাথে থাকার সংস্কৃতি। সেটা পরিবর্তন হচ্ছে। যার ফলে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। পারিবিারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ আত্মকেন্দ্রিকতার দিকে যাচ্ছে। যার পরিণতি এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা একটি ঠিকানাহীন সমাজের দিকে যাচ্ছি।

এই প্রবণতা বিত্তশালী ও শিক্ষিতদের মাঝে বেশি। ফলে দেখা যাচ্ছে, সম্পদের ভাগ বটোয়ারার দ্বন্দ্বে পিতার লাশ দাফন না করে দিনের পর দিন রেখে দেয়া হচ্ছে। পিতা-মাতাকে আলাদা রাখা হচ্ছে আর্থিক সক্ষমতার সুযোগ নিয়ে। আর ধনীরা প্রবল প্রতিযোগিতার দৌড়ে পরিবারে বয়স্কদের সময়ই দিচ্ছেন না। আর নিম্নবিত্তরা বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের প্রয়োজনেই কম বিচ্ছিন্ন।

যৌথ পরিবারে এই সমস্যা অনকে কম। বাস্তবতার কারণেই যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। কোনটা ভালো, যৌথ না একক পরিবার সেটা নিয়ে নানা মত আছে। কিন্তু একক পরিবার হলেও সেটা পরিবার হতে হবে। কিন্তু আদর্শ পরিবার ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ছে। এটাই সমস্যা।

বয়স্করা এখন আর আড্ডা দিতে পারেন না, আগে যে পাড়ার ক্লাব বা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন তা এখন আর নেই। তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। তারা রাজনৈতিক আলাপ পছন্দ করেন। সেই সুযোগও এখন কমে আসছে। আর পরিবারের অন্য সদস্যরা ব্যস্ত থাকায় তারও সময় দেন না। আলাদা থাকলে তো কথাই নেই। পুরোপুরি বিছিন্ন হয়ে পড়েন।

সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এবং অবিশ্বাসও বিচ্ছিন্নতার কারণ বলে মনে করেন সমাজ বিশ্লেষকরা। এখানে মানুষের জন্য মানুষ এগিয়ে গেলে উল্টো বিপদে পড়তে হয়। তাই শহুরে মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একা থাকছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ল্যাঙ মারার সংস্কৃতি। হয়তো এটাকে স্বাভাবিক বলে আমরা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু সমাজে এর অনেক ক্ষতিকর প্রভাব আরও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে।

আরও পড়ুন: কী ঘটবে ১০ ডিসেম্বর?

বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কথা, বাংলাদেশে ক্রমেই বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়বে। উন্নত চিকিৎসা, খাদ্য ও শিশু মৃত্যু কমে যাওয়ায় গড় আয়ু বাড়ছে। এখন দেশে প্রবীণের সংখ্যা দেড় কোটির বেশি। ২০৫০ সালে তাদের সংখ্যা হবে পাঁচ কোটি। এই প্রবীণদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা কাজে লাগানোর রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা এখনই নিতে হবে। প্রবীণরা এক সময়ে পরিবারে নাতি-নাতনি নিয়ে সময় কাটাতেন। এখন সেটা আর নেই। তারা নিঃসঙ্গ থাকেন। কিন্তু এখন যেহেতু গড় আয়ু বেড়ে গেছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে তাই অবসরের পরও তার কর্মক্ষম থাকছেন। সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এটাকে বলে পপুলেশন রিডিভিডেন্ট। এক সময় বয়স্ক মানুষ আরও বেড়ে যাবে। তাই তাদের জন্য এখনই রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রয়োজন।

শিশুরা ভয়বহ পরিস্থিতির মুখে পড়ছে:
তবে আরও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে শুধু বয়স্করা নয়, এখন শিশুরাও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। আর তাদের এই নিঃসঙ্গতার জায়গা দখল করে নিচ্ছে ইলেকট্রনিক গ্যাজেট। তারা এক ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হয়ে উঠছে। যার সঙ্গে বাস্তব জীবনের কোনো মিল নেই। ফলে বাস্তব জীবনে পা রাখতে গিয়ে তারা হোঁচট খাচ্ছে।

শহুরে শিশুদের বাবা-মা ব্যস্ততার কারণে সময় দেন না। তাদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠও নেই। বাবা-মা নিরাপত্তার কারণে শিশুদের বাইরে যেতে দিতে চান না। সব মিলিয়ে তারাও বিচ্ছিন্ন হয়ে  হয়ে পড়ছে। তারাও হচ্ছে ঠিকানাবিহীন।

আর এই আসক্তি তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। বয়স বাড়লে তাদের একটি অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে তাই এখনই না ভাবলে একটি অদক্ষ এবং সমাজ বিচ্ছিন্ন তরুণ জনগোষ্ঠী পাব আমরা। তা হবে আমাদের জন্য আরও ভয়াবহ।

]]>

সূত্র: সময় টিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *