Skip to content

বাংলাদেশ কি নদীশূন্য হওয়ার পথে? | সময় স্পেশাল

বাংলাদেশ কি নদীশূন্য হওয়ার পথে? | সময় স্পেশাল

<![CDATA[

বাংলাদেশের নদীগুলো মরতে মরতে এখন আশঙ্কাজনক সংখ্যায় পৌঁছেছে। গত ৫০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, বছরে গড়ে ১০টি নদীর মৃত্যু হচ্ছে। অথচ এখনও মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো জড়িয়ে আছে নদী। কিন্তু সেটা কেবল মানচিত্রেই, বাস্তবতা ভিন্ন।

শুধু ভিন্নই নয়, বরং গবেষকরা বলছেন, নদীর মৃত্যু ঠেকানো না গেলে বাংলাদেশের জলবায়ু, জনজীবন ও অর্থনীতিতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনকি বাংলাদেশ হতে পারে নদীশূন্য।

 

রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) তথ্যমতে, গত ৫০ বছরে প্রায় ৫০০ নদীর মৃত্যু হয়েছে। এসব নদী মরে যাওয়ার কারণ হিসেবে গবেষণায় উঠে এসেছে নদীর পলিপ্রবাহ কমা, নদী দখল ও আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানি সরিয়ে নেয়া।

 

‘নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে’ ১০ পর্বের সিরিজের প্রথম পর্বে গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্র ধরে দেখার চেষ্টা করা হবে বাংলাদেশ সত্যিই নদীশূন্য হওয়ার পথে কি না!

 

আরডিআরসির স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ১১টি সেক্টরের ওপর একটি গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭১ সালে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৭৪টি। ২০২১ সালে এসে মৃত্যু হয়েছে ৫০৪ নদীর। নদীরক্ষা কমিশনের সবশেষ তথ্যানুযায়ী (২০২৩), দেশে এখন নদীর সংখ্যা ৭৫৬টি। কেবল গত দুই বছরেই বাংলাদেশ হারিয়েছে ১৪টি নদী।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি ও পলিপ্রবাহে ক্রমাগত বাধা, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, অবৈধ দখল, ব্যাপক দূষণ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে প্রতিনিয়ত নদী মরে যাচ্ছে।

 

বাংলাদেশ নদীশূন্য হতে পারে–এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ সময় সংবাদকে বলেন, ‘অবশ্যই বাংলাদেশ নদীশূন্য হওয়ার পথে। এই যে পাঁচ শতাধিক নদী বিলীন হলো, এর প্রধান কারণ নদীতে প্রবাহ না থাকা। আর প্রবাহ না থাকলে দখল হয়। আরেকটি বড় কারণ আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রবাহ না থাকা।’

 

‘চীন ও ভারতের নদীসংযোগ প্রকল্পগুলোর কারণে আমাদের এখানে লবণাক্ততা বাড়বে। মানব স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে মানুষ বসবাস করতে পারবে না। এ ছাড়া নদীভাঙন বাড়বে। শুধু তা-ই নয়, এখন ২২টি জেলায় ভাঙন হয়, তখন আরও বাড়বে। এটা বাড়তেই থাকবে। কারণ, শুকনো নদীতে হঠাৎ করে পানি এলে সেটা ভাঙবেই,’ যোগ করেন তিনি।

 

পলিপ্রবাহ কমছে কেন
পলিপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ার কয়েকটি কারণের একটি নদীগুলোর অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা। তবে প্রধান কারণ হিসেবে গবেষণায় উঠে এসেছে–আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পলিপ্রবাহ কমে যাওয়া। এর ক্ষতিকর প্রভাবে বড় নদীগুলোর শাখা নদী মৃত্যুর পথে। এমনকি পদ্মার মতো তেজি নদীর আয়তনও কমেছে প্রায় অর্ধেক। গবেষণা প্রতিবেদনের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে, আন্তঃসীমানার নদীগুলোর উজানে বাঁধের আগে-পরে কেমন ছিল বা কী পরিবর্তন হতে পারে।

 

বিশ্বের বৃহত্তম নদীব্যবস্থা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (জিবিএম) অববাহিকা নিয়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। তাতে উঠে এসেছে জলবায়ুর পরিবর্তনে এ অববাহিকায় ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাত ও পলিপ্রবাহ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু একের পর এক বাঁধ নির্মাণের গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পলিপ্রবাহ বাড়বে তো না-ই; বরং বর্তমানের চেয়ে কয়েক গুণ কমে যাবে। কমে যাওয়ার হার বাংলাদেশের জন্য ভীষণ ভীতিকর।

 

এ জন্য ভীতিকর যে, গত ৫০ বছরে এরই মধ্যে ৫০০ নদী মরে গেছে। এ পরিসংখ্যান যখন, তখনও জিবিএম ব্যবস্থার আওতাধীন নদীগুলোর শাখা-উপশাখা নদীগুলোর উজানের বার্ষিক পলিপ্রবাহ ১০০ কোটি টনেরও বেশি। ঠিক এ অবস্থা ৫০০ নদী বিলীন!

 

কিন্তু বাঁধগুলো নির্মাণ ও বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেয়া হলে প্রশ্ন ওঠে: বাংলাদেশ কি নদী শূন্য হওয়ার পথে?

 

পানির স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চর

 

‘জিওমরফিক চেঞ্জ ইন দ্য গ্যাঞ্জেস-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ডেলটা’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, উজানে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ ও আন্তঃনদীসংযোগ তৈরির মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করা হলে চলতি শতকের শেষে জিবিএম অববাহিকার নদীগুলোয় পলিপ্রবাহ হ্রাস পেতে পারে ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত। এক লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ অববাহিকায় ১৭ কোটি মানুষের জনজীবন শঙ্কায় পড়বে। বিশেষত বাংলাদেশে বাড়বে লবণাক্ততা। ফলে রোগবালাইসহ নানান সংকটের মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে। এমনকি দেশ হতে পারে নদীশূন্য!

 

প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, জিবিএম অববাহিকার দেশগুলোর পরিকল্পনাধীন বাঁধের সংখ্যা ৪১৪টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নির্মাণের কথা রয়েছে নেপালে—২৮৫টি। ভারতে ১০৮টি, ভুটানে ১২, চীনে ৮ ও বাংলাদেশে ১টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব বাঁধের জাঁতাকলে ১৭ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হবে।

 

পরিকল্পনাধীন এসব বাঁধের সব কটিই নির্মাণ হবে ধরে নিয়ে গবেষকদলের হিসাবমতে, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও প্রভাবকের ভিন্নতা বিবেচনায় বার্ষিক পলিপ্রবাহ হ্রাসের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে কমপক্ষে ৭ কোটি ৯২ লাখ থেকে ৯ কোটি ২০ লাখ টন। আর অন্যসব প্রভাবক অপরিবর্তিত থাকবে ধরে নিলে বার্ষিক পলিপ্রবাহ হ্রাসের পরিমাণ হবে প্রায় ৬৭ কোটি টন।

 

পানিবণ্টন ও অসম প্রত্যাহার
নদীগুলোর মৃত্যুর পেছনে অন্যতম আরও একটি কারণ হলো পানিবণ্টন জটিলতা ও পানি প্রত্যাহার। পানিবণ্টন নিয়ে ভারত যেমন একাই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তেমনি পানি সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ভারত-চীন কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করছে।

 

তথ্য বলছে, একদিকে সাউথ টু নর্থ ওয়াটার ডাইভারশন প্রজেক্টের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদের চীনা অংশ অর্থাৎ ইয়ারলুং স্যাংপো থেকে পীত নদীতে বছরে ২০ হাজার কোটি ঘনফুট পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। অন্যদিকে ন্যাশনাল রিভার লিংকিং প্রজেক্টের (এনআরএলপি) আওতায় ৯ হাজার ৬০০টি খাল খননের মাধ্যমে নিজ সীমানার ৪৪টি নদীকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে পানি ও পলিপ্রবাহ ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাবে।

 

গবেষণা বলছে, ব্রহ্মপুত্রের পানি পীত নদীতে সরিয়ে নেয়া হলে নদীটির পলিপ্রবাহ হ্রাস পেতে পারে ৯ থেকে ২৫ শতাংশ। আর ভারতে এনআরএলপির মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেয়া হলে পদ্মায় পলিপ্রবাহ কমতে পারে ৩৯ থেকে ৭৫ শতাংশ। উজানের দুই দেশে এ দুই প্রকল্পের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার হলে তা বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাবে। পলি জমা হওয়ার হারে আসবে নাটকীয় পরিবর্তন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ভূমি নিচু হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন আসবে ব-দ্বীপ এলাকার গঠনগত ভারসাম্যে। উজানে বাঁধ নির্মাণের ফলে এরই মধ্যে জিবিএম অববাহিকায় বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

 

বাংলাদেশের গড়াই নদীর দিকে তাকালেই সেটা সহজে বোঝা যায়। এটি পদ্মার শাখা নদী। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে গড়াই নদীর পানি ভারতের ভাগীরথী ও হুগলি নদীতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। ফলে বিশাল চর পড়ে মরতে বসেছে গড়াই। শুধু তা-ই নয়, গত ৪০ বছরে পদ্মার আয়তন কমেছে অর্ধেকের বেশি। ‘জিওমরফিক চেঞ্জ ইন দ্য গ্যাঞ্জেস-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ডেলটা’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

 

গড়াইয়ে এখন আর ঢেউ ওঠে না, বুকে জমেছে পলি 

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘শুধু ফারাক্কা বাঁধের জন্যই অন্তত ১০০ নদীর মৃত্যু হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আমাদের নদীগুলোরও বড় ক্ষতি হয়েছে। বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে ভারতকে ৩১০-৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভারত সব ধরনের আলোচনা এড়িয়ে পানি সরিয়ে নেয়া চালু রাখে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে সেটা হতো না, সে দীর্ঘ আলাপ।’

 

বাংলাদেশ নদীশূন্য হওয়ার পথে কি না–জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন ‘বাংলাদেশ নদীশূন্য হওয়ার পথে নয়; বরং বলতে গেলে বাংলাদেশ নদীশূন্যই। এখন যেসব নদী আছে বলে আমরা ধরে নিচ্ছি, সেসব খাল হয়ে গেছে। নদীর সংজ্ঞায় এসব কোনোটিই আর নদীর পর্যায়ে নেই। এমনকি নদী রক্ষা কমিশন নদী পুনরুদ্ধারের জন্য নদী খনন করে বেশির ভাগকে খালে পরিণত করেছে। ফলে নদী দখল হয়ে যাচ্ছে।’

 

শরীফ জামিল আরও বলেন, ‘নদী একটি জীবন্ত সত্তা। নদী তার নিজস্ব অবস্থান নিয়ে চলে। এতে যেকোনো হস্তক্ষেপই নদীর উজান-ভাটিতে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং নদীকেন্দ্রিক সম্পদে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমাদের দেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার ভাটির দেশ। উজানের একতরফা বিভিন্ন প্রকল্পে নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে। যে কারণে শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না। আবার বর্ষা মৌসুমে বাঁধ খুলে দেয়ার পর আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। এটি মোটা দাগের সমস্যা। আরও সূক্ষ্ম অনেক সমস্যা আছে। মানুষ স্থানান্তরিত হয়। জীবিকা হারিয়ে যায়। নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত খালগুলো নষ্ট হয়ে যায়। অন্যান্য জলাশয় হারায়। বিল-হাওড়গুলো নষ্ট হয়ে যায়। মাছের প্রজনন নষ্ট হয়। এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।’

 

অভিন্ন নদীর ওপর কিছু করতে হলে তা যৌথভাবে আলোচনার মাধ্যমে হওয়া প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।

 

পলিপ্রবাহ হ্রাস ও পানি প্রত্যাহারের কারণে যখন নদীগুলো আধমরা হয়ে যায়, তখন সেসব নদী গিলে খায় দখলদার ও শিল্পকারখানার বর্জ্য। মরে যাওয়া নদী ছাড়াও জীবিত নদীগুলোকে তিল তিল করে দখল করছে দখলদাররা।

 

আগামী পর্বে থাকছে দখল-বাণিজ্যের আদ্যোপান্ত।

]]>

সূত্র: সময় টিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *