<![CDATA[
অতি সম্প্রতি উইমেন লিডারশিপ কর্পোরেশন আয়োজিত ‘গ্লোবাল অ্যাচিভার্স অ্যাওয়ার্ড-২০২২’ এ যোগ দেবার জন্য বলিউডের নৃত্যশিল্পী নোরা ফাতেহির বাংলাদেশ সফর নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছে। গত ১৮ নভেম্বর তিনি বাংলাদেশে এসে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে যোগদানের পূর্ব থেকেই নোরা ফাতেহির বাংলাদেশে আসা নিয়ে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হয়েছিল। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি নিয়ে। পরবর্তীতে সরকারের তরফ থেকে উক্ত অনুষ্ঠানে শর্ত সাপেক্ষে তাকে যোগদানের অনুমতি প্রদান করা হয়।
আরেকটি জটিলতা তৈরি হয়েছিল অনুষ্ঠানে যোগদানের ক্ষেত্রে তার পারিশ্রমিক মেটানোর বিষয়টিকে কেন্দ্র করে, কারণ তার পারিশ্রমিক প্রদান করতে হয়েছে ডলারে। ফলে, কিভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে তা নির্ধারণের জন্য বিষয়টি এনবিআর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। পরবর্তীতে, এনবিআর এর পক্ষ থেকে তার পারিশ্রমিক বা সম্মানীর উপর আইন অনুযায়ী উৎসে কর প্রদানের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল (কালবেলা, ১৪/১১/২০২২)।
বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে যে, নোরা ফাতেহি খুব অল্প সময়ের জন্য (পত্রিকার খবর অনুযায়ী মাত্র ৪০ মিনিট) অনুষ্ঠানস্থলে ছিলেন এবং সেজন্য পারিশ্রমিক হিসেবে তাকে আয়োজকদের বৈদেশিক মুদ্রায় বিশাল অংকের অর্থ প্রদান করতে হয়েছে।
বর্তমান বৈশ্বিক মন্দার প্রেক্ষাপটে এই ধরণের একটি অনুষ্ঠানে নোরা ফাতেহির মতো শিল্পীর অংশগ্রহণ কতটা জরুরি ছিল তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, তিনি যেহেতু একজন নৃত্যশিল্পী তার নাচ দেখবার জন্য দর্শকরা অনেক উচ্চমূল্য দিয়ে টিকিট কেটেছিলেন। ফলে, দর্শকদের কাছে উচ্চমূল্যে টিকিট বিক্রি করে আয়োজকরা হয়তো বড় অঙ্কের অর্থ আয়ের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তার নৃত্য পরিবেশন করেননি। বর্তমান সময়ের বাস্তবতা তাকে এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তব সম্মত ছিল-তা ভেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য বর্তমান সরকারের অবদান অনস্বীকার্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজকের নারীরা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ফলে, নারীদের ক্ষমতায়ন কিংবা নারীদের উৎসাহিত করবার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ সকল ক্ষেত্রেই কাম্য। কিন্তু যারা এই ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করবেন তাদের ভাবা দরকার যে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এ রকম একটি অনুষ্ঠানে নোরা ফাতেহির উপস্থিতি কতটা প্রয়োজন ছিল? যখন ডলার সংকটের কারণে সরকার বিলাস সামগ্রীর আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, ঠিক সেই সময় বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নোরা ফাতেহির অনুষ্ঠানে উপস্থিতি কতটা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল-সেটি ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।
আরও পড়ুন: আমলা: ঠেলা সামলার আরেক অ্যাপিসোড
বিভিন্ন দেশে যে সকল নারী সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাদের জীবনের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের নারীদের সাথে শেয়ার করলে আমাদের দেশের নারীরা তা থেকে অনুপ্রাণিত হবেন-এই বিষয়ে দ্বিমত করবার অবকাশ নেই। এই বিষয়টি যেমন একটি বাস্তবতা, ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার সময় এত টাকা খরচ করে তাকে অতিথি হিসেবে এই অনুষ্ঠানে নিয়ে এসে ডলারে পারিশ্রমিক মেটানোর সিদ্ধান্তটি আরেকটু যৌক্তিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করে নেওয়া উচিত ছিল বলে দেশের বেশিরভাগ জনগণ মনে করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল অনেক নারীরা রয়েছেন যারা জীবন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই অনুষ্ঠানে তাদের মধ্য থেকে কাউকে এনে তার অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে শেয়ার করার সুযোগ দিলে অন্য নারীরাও উদ্দীপ্ত হতে পারতো।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে পৃথিবীব্যাপী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হলে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে শুরু করেছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেকটাই কমে এসেছে এবং সেটি যদি আরও কমতে থাকে তাহলে সামনের দিনগুলোতে এক ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও সরকার কৃচ্ছতা সাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি জনগণের জীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব দেশের জনগণের জীবনযাত্রার উপর পড়তে শুরু করেছে। ঠিক সেই সময় বেসরকারি উদ্যোগে এ ধরনের কর্মসূচি বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেগ করেছে।
দেশের যে কোনো ক্রান্তিকালে (তা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা হোক বা করোনা অতিমারিই হোক) সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগকেও ইতিবাচকভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে। যে কোনো বিপদ থেকে দেশ বা রাষ্ট্রকে উদ্ধার করার দায়িত্ব সরকারের একার নয়। সরকারের সাথে সাথে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এই যুদ্ধে সরকারের পাশে থাকার জন্য। কিন্তু রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলেও বেসরকারি উদ্যোগে যদি এমন সব কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয় তাহলে সেই সকল কার্যক্রমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হলে তা হবে আগামী দিনের জন্য অশনিসংকেত।
আরও পড়ুন: জঙ্গি ছিনতাই ও প্রাসঙ্গিক বিষয়
ফলে ভবিষ্যতে যারা এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের চিন্তা-ভাবনা করবেন তাদের উচিত বিষয়টিকে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করে তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এমনকি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যারা বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছেন তাদের উচিত এ ক্ষেত্রে আরও যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এই ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি প্রদান করা। আমাদের মনে রাখতে হবে আগামী বছর নির্বাচনের বছর। অতএব এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে সরকারের উচিত খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। তবে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশকে আরও শক্তভাবে আঘাত করলে সেটি দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। আমরা আশা করব সকলের ঐকান্তিক সহযোগিতায় এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে, যেটি করা সম্ভব হয়েছিল কোভিড-১৯ অতিমারির সময়।
]]>