Skip to content

যেভাবে জীবনের মোড় ঘুরে যায় চায়ের দোকানে কাজ করা পেলের | খেলা

যেভাবে জীবনের মোড় ঘুরে যায় চায়ের দোকানে কাজ করা পেলের | খেলা

<![CDATA[

১৯৫০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয় ব্রাজিলের মাটিতে। লিগ পদ্ধতির সে আসরে অলিখিত ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে হেরে দেশটির প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপার স্বপ্ন ধুলিস্ম্যাৎ হয়ে যায়। মারাকানার সেই ফাইনাল এক শিশুর মনে দাগ কেটে যায়। পণ করেন এই শিরোপাটা একদিন ছুঁয়ে দেখবেন। ফুটবল পাগল ব্রাজিলিয়ানদের উপহার দেবেন শিরোপাটা। মাত্র ৮ বছর পর ১৭ বছর বয়সে সেদিনের শিশুটি কথা রেখেছিলেন। নায়ক হয়ে ব্রাজিলকে এনে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের ট্রফিটা। সেই স্বপ্নবাজ আর কেউ নন, তিনি ফুটবলের রাজা পেলে।

এডসন অ্যারান্তেস দো নসিমন্তে; ফুটবলের রাজা পেলে নামেই তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তাকেই বলা হয় সর্বকালের সেরা ফুটবলার। ১৯৪০ সালে ব্রাজিলের এক বস্তিতে জন্ম হয়েছিল পেলের। এডসন অ্যারান্তেস নাম রাখা হলেও বন্ধুদের কাছে তার পরিচয়টা ছিল ডিকো নামে।

দারিদ্র্যের কারণে ছোট বয়সে চায়ের দোকানে কাজ নিতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু হৃদয়ে ছিলো ফুটবল। ব্রাজিলের আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই গলির ফুটবল ছিলো তারও অবসরের সঙ্গী। কিন্তু সত্যিকারের ফুটবল কেনার টাকা ছিল না বলে মোজার ভেতরে খবরের কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চলত তার অনুশীলন। তবে পেলের ছিলো সহজাত প্রতিভা।

গলির ফুটবলে পেলের প্রতিভা চোখে পড়ে সান্তোসের কিংবদন্তি ওয়ালদেমার ডি ব্রিতোর। পেলের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট এই ঘটনাই। ১৫ বছর বয়সী পেলেকে গলি থেকে উঠিয়ে সান্তোসে নিয়ে যান ব্রিতো। সান্তোসের বি দলের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু হয় পেলের। এরপর আর পেছনে ফিরে দেখার প্রয়োজন হয়নি তার। বছরখানেকের মধ্যেই জায়গা করে নেন সান্তোসের মূল দলে।

সান্তোসে প্রথম মৌসুমেই ১৬ বছরের পেলে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এ সময় পেলের নাম ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপেও। তাকে দলে ভেড়াতে উঠেপড়ে লাগে রিয়াল মাদ্রিদ, য়্যুভেন্তাস, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো জায়ান্টরা। ১৯৫৮ সালে ইন্টার মিলানের সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তিও হয়ে যায় পেলের। কিন্তু সান্তোস সমর্থকদের দাবির মুখে এই চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয় তারা।

১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই; এ দিনই ব্রাজিলের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় পেলের। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মাত্র ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে খেলতে নেমে গোল করেন পেলে। ম্যাচটি অবশ্য ২-১ ব্যবধানে হারে ব্রাজিল। এই ম্যাচ দিয়েও ফুটবল ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হিসেবে নাম লেখান পেলে।

আরও পড়ুন: বিশ্বকাপ শেষে আগের রূপে ফিরবে আহমদ বিন আলী স্টেডিয়াম

১৯৫৮ সালে ১৭ বছরের পেলে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসেই বনে যান নায়ক। সাইড স্ট্রেইন ইনজুরির জন্য পেলের বিশ্বকাপের দলে থাকা নিয়েই ছিলো সন্দেহ। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের মঞ্চে যাওয়া হয় পেলের। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচে প্রথমবার মাঠে নামেন তিনি। আর নেমেই গড়েন সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপ খেলার রেকর্ড। সে ম্যাচে ভাভার গোলে সহায়তা করেন তিনি। এরপর সেমিফাইনালে পেলে নিজের জাত চেনান ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সবচেয়ে কম বয়সে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড তারই।

পেলে যেদিন প্রথমবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে নামেন সেদিন তার বয়স ১৭ বছর ২৪৯ দিন। তার এই রেকর্ডও আজ পর্যন্ত অক্ষত। সুইডেনের বিপক্ষে ফাইনালে জোড়া গোল করেন তিনি। স্টকহোমের সে ফাইনাল ব্রাজিল জেতে ৫-২ গোলে।

ফাইনালে তার প্রথম গোলটিকে বিশ্বকাপের ইতিহাসেই অন্যতম সেরা গোলের মর্যাদা দেয়া হয়। সেদিন বল পেয়ে প্রথমে এক ডিফেন্ডারের মাথার ওপর দিয়ে ফ্লিক করেন তিনি। এরপর দারুণ ভলিতে জড়িয়ে দেন জালে।

পেলের খেলায় প্রতিপক্ষ কতটা সম্মোহিত হয়ে পড়ত তার প্রমাণ মেলে ফাইনালে দ্বিতীয় গোলটি প্রতিপক্ষের যে ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে করেছিলেন তার কথায়। সুইডিশ ডিফেন্ডার সিগভার্ড পার্লিং বলেন, ‘যখন পেলে ফাইনালের পঞ্চম গোলটি করলেন, সত্যি বলতে আমার মনে হচ্ছিল, আমি করতালি দেই।’

আরও পড়ুন: বিশ্বকাপের জন্য নির্বাচকদের দৃষ্টি কাড়তে চান রুবেল

১৯৫৮-১৯৭০ পর্যন্ত চারটি বিশ্বকাপ খেলে ৩টিতেই চ্যাম্পিয়ন হন পেলে। বিশ্বকাপে ১৪ ম্যাচে করেন ১২ গোল।

১৯৬১ সালে জানিও কুয়াড্রসের নেতৃত্বাধীন ব্রাজিলের সরকার পেলেকে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। যার কারণে ব্রাজিলের বাইরে ইউরোপিয়ান লিগে খেলার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় পেলের।

১৯৬২ বিশ্বকাপে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে যায় ব্রাজিল। চিলিতে অনুষ্ঠিত সে বিশ্বকাপে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হিসেবেই অংশ নেন পেলে। প্রথম ম্যাচেই মেক্সিকোর বিপক্ষে একটি অ্যাসিস্ট করেন তিনি। পরে সে ম্যাচে গোলও করেন পেলে। প্রতিপক্ষের চার ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোলটি করেন তিনি। তবে দ্বিতীয় ম্যাচেই ইনজুরিতে পড়ে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায় তার। চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে একটি লং রেঞ্জ শট নিতে গিয়ে ইনজুরিতে পরেন তিনি। তবে সে বিশ্বকাপে গ্যারিঞ্চার নৈপুণ্যে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল।

১৯৬৬ সালে ক্যারিয়ারের তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ড যান পেলে। এই বিশ্বকাপে তাকে আটকাতে প্রতিপক্ষ এক ঘৃণ্য কৌশল গ্রহণ করে। ক্রমাগত মারাত্মক ফাউল করে তার জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে ইউরোপিয়ান দলগুলো। প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়া ও গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে পর্তুগালের উপর্যুপরি ফাউলে আহত হন পেলে।

এরই মধ্যে প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ফ্রি-কিকে গোল করে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপে গোল করার কৃতিত্ব দেখান পেলে। তবে ইনজুরির কারণে হাঙ্গেরির বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচটি মিস করেন। তৃতীয় ম্যাচে পর্তুগালের খেলোয়াড়দের ক্রমাগত ফাউলে মাঠে থাকা দুর্বিষহ হয়ে পড়ে তার। সে সময়ে হলুদ কার্ড বা লাল কার্ডের কোনো নিয়ম ছিল না বিশ্বকাপে। পর্তুগিজ ডিফেন্ডার জোয়াও মরিয়াসের মারাত্মক ফাউল সত্ত্বেও নির্বিকার থাকেন রেফারি। বদলি খেলোয়াড়ের নিয়ম না থাকায় এর পর ম্যাচের বাকি অংশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনো মতে শেষ করেন তিনি। প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেয় ব্রাজিল। এই বিশ্বকাপের পর পেলে ঘোষণা দেন যে, তিনি আর কোনো বিশ্বকাপ খেলবেন না। পরে অবশ্য এই সিদ্ধান্ত তিনি পরিবর্তন করেন।

আরও পড়ুন: বিশ্বকাপের ৬ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে ‘৯৭৪ স্টেডিয়ামে’

১৯৭০ বিশ্বকাপে শেষবারের মতো বিশ্বকাপ খেলেন পেলে। যদিও প্রথমে এই বিশ্বকাপ খেলতে ইচ্ছুক ছিলেন না পেলে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদলে বাছাই পর্বের শেষ ৬টি ম্যাচ খেলে ৬ গোল করেন। ১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিল দল থেকে বিদায় নিয়েছেন আগের বিশ্বকাপগুলোয় তার সতীর্থ গ্যারিঞ্চা, নিলটন স্যান্তোস, ভালদির পেরেইরা, দিলমা স্যান্তোস ও গিলমার। তবে পেলে, রিভেলিনো, জায়ারজিনহো, গারসন, টোস্টাও ও ক্লোদোয়ালদোদের এই দলটি ছিল ফুটবল ইতিহাসের সেরাদের একটি। এই বিশ্বকাপেও ফাইনালে ওঠে পেলের ব্রাজিল। গোটা টুর্নামেন্টেই দুর্দান্ত খেলেন পেলে। 

ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে জুলে রিমে ট্রফিটি স্থায়ীভাবে নিয়ে নেয় ব্রাজিল। ফাইনালে প্রথম গোলটি হেড থেকে করেছিলেন পেলে। এটি ছিল বিশ্বকাপে ব্রাজিলের শততম গোল। গোলের পর পেলে দৌঁড়ে গিয়ে সতীর্থ জায়ারজিনহোর কোলে চেপে বসেন। এরপর হাত ওপরে তুলে উদযাপন করেন। এটি বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা আইকনিক দৃশ্য হিসেবে বিবেচিত। এ ম্যাচের বাকি তিন গোলের দু’টিতেও আছে পেলের অবদান। সে বিশ্বকাপে ব্রাজিলের করা ৫৩ শতাংশ গোলেই ছিল পেলের অবদান। বিশ্বকাপে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়ে সেরা খেলোয়াড়  হিসেবে গোল্ডেন বল জেতেন তিনি।

ফাইনালে পেলেকে মার্ক করার দায়িত্বে থাকা ইতালিয়ান ডিফেন্ডার বার্গনিচ বলেন, ‘আমি এই ম্যাচের আগে নিজেকে বলেছিলাম, সেও আমাদের সবার মতোই হাড়-মাংসের মানুষ কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।’

১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বিদায় নেন পেলে। ব্রাজিলের হয়ে রেকর্ড ৬৭ জয়, ১৪ ড্র এবং ১১ হার নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করেন তিনি।

ক্লাব ক্যারিয়ারের বড় অংশটাই তিনি কাটিয়েছেন স্বদেশি ক্লাব স্যান্তোসে। ক্লাবটির হয়ে ৬৩৬ ম্যাচে করেছেন ৬১৮ গোল। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে তিনি পাড়ি জমান নিউইয়র্ক কসমসে। আমেরিকায় ফুটবল জনপ্রিয় করে তুলতেই মূলত সেখানে যান তিনি। কসমসের হয়ে ৬৪ ম্যাচে ৩৭ গোল করেন তিনি।

ক্যারিয়ারে হাজারের বেশি গোল করা পেলের ফিফা স্বীকৃত অফিসিয়াল গোলের সংখ্যা ৭৫৭টি। পেলের হিসেবে ক্যারিয়ারে তার করা গোলের সংখ্যা ১২৮৩টি।

ব্রাজিলের জার্সিতে ৭৭ গোল নিয়ে তিনিই দেশটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা।

১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি তাকে ‘অ্যাথলিট অফ দ্য সেঞ্চুরি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফুটবল হিস্ট্রি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস (আইএফএফএইচএস) তাকে বিংশ শতাব্দীর সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি দেয়। এছাড়াও তিনি ফিফার ‘প্লেয়ার অফ দ্য সেঞ্চুরি’ এর দুই বিজয়ীর একজন।

এক নজরে পেলে: 
পুরো নাম: এডসন অ্যারান্তেস দো নসিমন্তে
জন্ম: ২৩ অক্টোবর, ১৯৪০, মিনাস গেরাইস, ব্রাজিল
পজিশন: অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার/ফরোয়ার্ড
জাতীয় দল ব্রাজিল (৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল) 
বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স: ১২ গোল।

]]>

সূত্র: সময় টিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *