Skip to content

যেভাবে দেশের টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে | সময় স্পেশাল

যেভাবে দেশের টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে | সময় স্পেশাল

<![CDATA[

সম্প্রতি সিআইপি সম্মাননা অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কেউ কানাডায় ৩ কোটি টাকা পাঠাতে চাইলে দুইদিনও লাগবে না।’ যেখানে বৈধ পন্থায় দেশের টাকা কোনো কারণে বিদেশে পাঠাতে চাইলে রীতিমতো পদ্ধতিগত জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেখানে অবৈধ উপায়ে বিদেশে টাকা পাঠানো এক রকমের পানিভাত।

কীভাবে এত সহজে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা হয়? টাকা পাচারের মাধ্যমগুলো কী? এসব বিষয়ে সময় সংবাদের সঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা হয় কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার। তারা জানান কীভাবে ব্যাংককে কাজে লাগিয়ে নাকের ডগার ওপর দিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। এছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত কোন্ কোন্ মাধ্যমে টাকা পাচার হয় সে ব্যাপারেও বিস্তারিত আলোচনা করেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।

 

আবারও কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যে ফিরে যাওয়া যাক। একই অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন, ‘ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশ পাচার করা হচ্ছে।’ এতে করে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে ইনভয়েসিং আসলে কী? এ ব্যাপারে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, সহজভাবে বলতে গেলে ইনভয়েসিং হচ্ছে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের এক ধরণের মেমো বা রশিদ। মূলত ঋণপত্র বা লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খুলে আমদানি-রফতানির আড়ালে যে টাকা পাচার হয় সেখানে ইনভয়েসিং পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হয়।

 

আমদানি-রফতানিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে টাকা পাচার হয় সে ব্যাপারে এক প্রাইভেট ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা কোনো পণ্য ক্রয় করতে গেলে আগে তাকে এলসি খুলতে হবে। এলসি খোলার প্রক্রিয়ায় ব্যাংককে দেখাতে হবে কোন পণ্য কত দামে ক্রয় করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বেশি দেখায়। সহজ করে বললে, ধরা যাক একজন ব্যবসায়ী যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু খাদ্যপণ্য আনবে। বর্তমান বাজারে সেই খাদ্যপণ্যের দাম হয়তো কেজিপ্রতি ৫০০ টাকা, কিন্তু ব্যাংককে দেখানো হলো ৮০০ টাকা। এক্ষেত্রে পূর্বপরিকল্পনা মাফিক যেখান থেকে পণ্য ক্রয় করা হবে তাদেরকে হাতে রাখেন ব্যবসায়ীরা। অনেক সময় দেখা যায়, বিদেশে আত্মীয়-স্বজন থাকার সুবাদে তাদেরকে কাজে লাগিয়ে পণ্যের দাম হেরফের করে দেখানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেখান থেকে পণ্য আনা হবে সেটা তার নিজেরই কোনো আত্মীয়ের প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে ৫ টাকার পণ্যের দাম ১০ টাকা দেখানো কোনো ব্যাপার না। এভাবে দাম বাড়িয়ে যে রশিদ তৈরি করে এলসি খোলা হয় সেটিকে মূলত ওভার ইনভয়েসিং বলে। এর মাধ্যমে চাইলেই একজন ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা বিদেশ পাচার করতে পারেন। অনেকক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের সম্পর্ক ভালো হওয়ায় কিংবা রাজনীতিবিদ নিজেই ব্যবসায়ী হওয়ায় সহজেই ওভার ইনভয়েসিং করে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা যায়।

 

চাইলেই যাচ্ছেতাই দাম দেখানো যায় কি না কিংবা এসব ব্যাপারে ব্যাংক কোনো তদারকি করে কি না সে সম্পর্ক তিনি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোন্ পণ্যের দাম কত সেটি নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যবস্থায় একেক জায়গায় পণ্যের দাম একেক রকম। এমনকি একেক প্রতিষ্ঠানে একেক রকম দাম থাকায় কোনো পণ্যে দামের ব্যবধান হলে, কেন সে ব্যবধান হলো এমন প্রশ্ন তোলা অবান্তর। এই সুযোগটিই কাজে লাগান ব্যবসায়ীরা। তারা নিজেদের মতো করে দাম ঠিক করে ওভার ইনভয়েসিং করে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেন।

 

অন্যদিকে আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে আরেক পন্থায় দেশে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়। এ ব্যাপারে আরেক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, আমদানির ক্ষেত্রে পণ্য ও পণ্যের দামের ওপর  মূলত শুল্কহার নির্ভর করে। এক্ষেত্রে পণ্য আমদানির সময় দাম কমিয়ে দেখালে বড় রকমের শুল্ক ফাঁকি দেয়া সম্ভব। ধরা যাক, একটি গাড়ির দাম হয়তো ২ কোটি টাকা, এক্ষেত্রে অনেক সময় শতভাগ কিংবা আরও বেশি কর দিতে হয় ক্রেতাকে। কিন্তু গাড়ির দাম যদি কমিয়ে ৫০ লাখ দেখানো হয়, সেখানে এক ধাক্কায় করের পরিমাণ অনেকটা কমে আসে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে বাকি টাকা কীভাবে পরিশোধ করা হবে? সেক্ষেত্রে মূলত হুন্ডির আশ্রয় নেয় অসৎ ব্যবসায়ীরা। এভাবেই আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে একদিকে দেয়া হয় কর ফাঁকি, অন্যদিকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশের টাকা পাচার করে বিদেশে পাঠানো হয়।

 

একইভাবে রফতানির ক্ষেত্রেও আন্ডার ইনভয়েসিং করে শুল্প ফাঁকি দেয়া হয়। পরবর্তীতে আবার হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেশের আরেক দফা ক্ষতি করেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যাপারে ব্যাংক কোনোভাবে জড়িত কি না জানতে চাইলে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, এককথায় দায়মুক্তি দেয়া যায় না। অনেকক্ষেত্রে আমরা দাম দেখে বুঝতে পারি এখানে ঝামেলা আছে। কিন্তু ঝামেলা থাকলেও পরিপার্শ্বিক চাপের কারণে তেমন কিছু করা যায় না। কিছুক্ষেত্রে দেখা যায়, পণ্য না এনে ভুয়া ইনভয়েসিং করা হয়। এটা ব্যাংকের অজ্ঞাতসারে সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক জড়িত থাকে।

 

হুন্ডির মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা কীভাবে বিদেশে পাচার করা হয় জানতে চাইলে বিভিন্ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, একটি হচ্ছে অবৈধ কোনো চ্যানেলকে কেন্দ্র করে টাকা পাঠানো। আরেকটি হচ্ছে সমঝোতার মাধ্যমে হুন্ডি করে টাকা পাঠানো। সমঝোতার হুন্ডির ব্যাপারে কর্মকর্তারা বলেন, ধরা যাক দেশের মধ্যে কারো কাছে অবৈধ কয়েক কোটি টাকা আছে। চ্যানেল ধরে তিনি টাকা পাঠাতে ভরসা পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে বিদেশে থাকা তার পরিচিত কেউ বা এজেন্ট ধরে প্রবাসী কোনো হোয়াইট কলার বাংলাদেশি দেশে বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতে চাইলে সেখানে দেশে থাকা ব্যক্তি প্রবাসীর হয়ে টাকা দিয়ে দেন আর বিনিময়ে সেই প্রবাসী অবৈধ অর্থের মালিক বা আত্মীয়র অ্যাকাউন্টে সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা জমা করেন। এ ধরণের কর্মকাণ্ডে একদিকে অবৈধ কাজ করে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান অপরাধীরা, অন্যদিকে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারায় বাংলাদেশ।

 

গত বছর বাংলাদেশের ব্যাংকের দেয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, ওভার বা আন্ডার ইনভয়েসিং করে ক্ষেত্রেবিশেষে পণ্যের দাম ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো বা কমানো হয়। এতে করে একেক চালানে কোটি কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) দেয়া তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রতিবছর গড়ে এ ধরণের ইনভয়েসিংয়ের কারণে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়। পাচারের পাশাপাশি একই কারণে প্রতিবছর ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ।

 

বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অবৈধ টাকার একটি অংশ সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখেন পাচারকারীরা। ২০০৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশিদের টাকার অঙ্ক দেখেই বোঝা যায়, দিনকে দিন দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের হার বাড়ছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশিদের সুইস ব্যাংকে রাখা টাকার পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। যা ২০২০ সালে কিছুটা কমে ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি হয়। কিন্তু ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।

 

যদিও প্রতিবছর বাজেটে কালো টাকা সাদা করার নানা ধরণের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তাতে লাভের লাভ খুব একটা হয়না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। গত বছরের বাজেটে হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়াও জমি, ভবন, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের ওপর প্রতি বর্গমিটারে নির্দিষ্ট হারে এবং গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের ওপর বিনিয়োগে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি টাকা পাচারকারীদের থেকে।

 

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা জানান, যারা বড় অঙ্কের টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার করেন তাদের মূলত দেশে থিতু হবার কোনো আগ্রহ নেই। বিশেষ করে যে মানুষ ১০ কোটি টাকা ঘুষ খেয়ে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা রাখছেন, তাকে যতই সুযোগ দেয়া হোক তিনি দেশে কোনোভাবেই টাকা ফিরিয়ে আনবেন না।

]]>

সূত্র: সময় টিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *