<![CDATA[
নুর কামাল, ৩১ বছর বয়সী এই ব্যক্তির পরিচয় এখন বাস্তুহীন, সম্পদহীন, দেশহীন রোহিঙ্গা হিসেবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৭ লাখ রোহিঙ্গার একজন নুর কামাল এই আগস্ট মাসে বাংলাদেশে উদ্বাস্তু তার ৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। নুর কামাল এখন বাংলাদেশের শফিউল্লাহ কাটা শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন। নুর জানেন না তার নিজ গ্রাম ‘মাইন হলুট’, যেটি মিয়ানমারে সংঘাত-বিধ্বস্ত মংডু টাউনশিপে কাছে অবস্থিত সেটির বর্তমান চিত্র।
প্রায় ২০ হাজার বাসিন্দার এই গ্রামের একেবারে কেন্দ্রে একটি বড় বাজার ছিল। নুরের কাছে এখনও বড় বাজার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। নুরের এখন চার বছরের ছেলে এবং দুই মেয়ে আছে। নুরের পৈত্রিকসূত্রে তিন একর জমি ছিল। পুরো পরিবারের খাদ্য জোগান এই জমি থেকেই আসতো। ২০১৭ সালে নুর যখন পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল সে সময় তার একটি ফার্মেসিও ছিল।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী পুরো গ্রামটি মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গা বাসিন্দাদের ফেলে যাওয়া সব ঘরবাড়ি সামরিক বাহিনী পুড়িয়ে দিয়ে বুলডোজার দিয়ে মিশিয়ে দিয়েছে। গ্রামটি যেখানে এক সময় দাঁড়িয়েছিল তার বেশিরভাগ জমি এখন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতা দখলকারী জান্তা কমান্ডের অধীনে সীমান্তরক্ষী বাহিনী দখল করেছে।
মিয়ানমারের মুক্ত সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার নাউ কিছু নথি প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বর্তমান দখলদারদের কাছে মালিকানা হস্তান্তর করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুটি টাউনশিপ-মংডু এবং বুথিডাং-এর মোট ৭০০ একরেরও বেশি জায়গা সামরিক নিয়ন্ত্রিত বর্ডার গার্ড পুলিশ ডিভিশন অফিসের কাছে হস্তান্তর করার প্রস্তুতি চলছে।
রোহিঙ্গাদের ভূমি দখলে নিষেধাজ্ঞা যেভাবে জান্তা সরকার উলটে দিচ্ছে
গত বছরের সেপ্টেম্বরে জান্তা সরকারের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রী মেজর জেনারেল সোয়ে টিন্ট নাইং মংডুর এলাকার জান্তার নিয়োগ করা শাসনকর্তার জারি করা আঞ্চলিক নির্দেশনা বাতিলের অনুমতি চান। এই নির্দেশনায় ছিল ‘বাঙালিদের’ পরিত্যক্ত জমি সীমিত ব্যবহার করতে হবে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে এই নির্দেশনায় ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করা হয়েছিল। এখন নির্দেশনা বাতিল চেয়ে চিঠি দেয়া মানে রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় স্বীকার করে নেয়া নয় বরং আনুষ্ঠানিকভাবে সেই সীমিত ব্যবহার করা জমিগুলির মালিকানা বর্ডার গার্ড পুলিশ ডিভিশন অফিসের অধীনে নিবন্ধন করা।
যদিও এই পদক্ষেপটি আশ্চর্যজনক নয়, এটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর প্রয়োগ করা “ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের” কারণে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা রোহিঙ্গাদের জমির অবৈধ দখল রোধ করার জন্য মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত বেসামরিক প্রশাসন যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল সেটিও বাতিল করা হয়েছে। ২০২০ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি মংডু টাউনশিপে তৎকালীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সরকার একটি নির্দেশনা জারি করে যাতে ‘যে সকল ব্যক্তির এই অঞ্চলের জমির মালিকানা নেই তারা সেখানে বসবাস, ফসল ফলানো এবং কৃষিকাজ করা থেকে যেন বিরত থাকে।’ এই নির্দেশনা জারি মিয়ানামারের সামরিক বাহিনী কখনই ভালো চোখে দেখেনি। কারণ এই নির্দেশনার অর্থই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জমিতে অন্য কারোর অধিকার নেই। সেটা মেনে নেয়া সামরিক বাহিনীর জন্যে কষ্টকর।
নুর মিয়ানমার নাওকে জানান, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী তাদের জমি দখল নেয়ার জন্য কী কী প্রক্রিয়া চালিয়েছে সে সম্পর্কে একেবারের অবগত নন। তবে এটাও বলেছেন, বর্তমান জান্তা বাহিনী যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন তাদের ভূমি ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম। নুর বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে এইভাবে নির্যাতিত এবং বৈষম্যের শিকার হয়েছি। তারা আমাদের জমি বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের কিছুই করার নেই।’
শুধু ৫ বছর নয়, দীর্ঘকাল ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের জমি বাজেয়াপ্ত করছে। কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে। ১৯৯০ সালে মিয়ানমারের বর্ডার ইমিগ্রেশন গার্ড যেটি নাসাকা বাহিনী নামে পরিচিত, তারা রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে। রোহিঙ্গাদের চলাফেরার স্বাধীনতা থেকে শুরু করে তাদের বিয়ে করার অধিকারে বিধিনিষেধ বলবৎ করে।
অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নে সান লুইনের মতে, শাসকগোষ্ঠী সর্বশেষ জমি দখলের যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার অর্থ হচ্ছে, যেসব রোহিঙ্গা গণহত্যার সময় বেঁচে বাংলাদেশে রয়েছেন, তারা যদি ফিরেও যান তবে উদ্বাস্তু শিবিরে থাকতে হবে। কারণ তাদের জায়গা এমনভাবে দখল করা হচ্ছে তা জান্তা সরকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় ফিরে এলে এই সমস্ত জমি রোহিঙ্গারা ফেরত পেতে পারেন বলে মত প্রকাশ করেছেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের ভূমি দখলের নির্মূল প্রক্রিয়ার সূচনা
নুর এবং তার চার বোন মাইন হুলুটে একটি কাঠের বাড়িতে বড় হয়েছেন। এটি মংডু শহরের প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। তিনি ২০১২ সালে স্নাতক পাস করেন। কিন্তু রোহিঙ্গা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন জনগণের মধ্যে সেই বছর সহিংস সংঘর্ষ হওয়ায় তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তাই তিনি মাইন-হালুটে থেকে যান। সেখানে তিনি একটি ফার্মেসি চালান। এছাড়া মাঝে মাঝে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ওই সময় ভেবেছিলেন, উত্তেজনা শিগগিরই কেটে যাবে। যখন ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ শুরু হয় তিনিসহ মাইন হালুটের প্রায় সবাই এতে আক্রান্ত হন। তারা সীমান্ত পার হয়ে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। আর তাদের ফেলে রাখা জায়গা দখল করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
মিয়ানমার নাউ-এর পাওয়া নথিতে দেখা যায়, নাসাকা বাহিনী বর্তমানে মাইন হালুটের ২শ’ একর জায়গা দখল করেছে। যার মধ্যে ১৫০ একর জায়গা পূর্বের গণতান্ত্রিক সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘সীমাবদ্ধ ভূমি’ হিসেবে চিহ্নিত। তার মানে হচ্ছে এই জমির পুরো মালিকানায় রোহিঙ্গাদের। মাইন হালুটের একজন প্রাক্তন প্রশাসক যিনি এখন বাংলাদেশের কক্সবাজারের বালুখালী শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, এগুলি আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকে আমাদের মালিকানাধীন জমি ছিল। তারা বাড়িঘর ও গ্রাম তৈরি করেছে, ফসল ফলিয়েছে এবং কর দিয়েছে।
কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের ২৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ রেজুয়ান খান। তার পরিবারের জমি বাজেয়াপ্ত করা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে করা অনেক অন্যায়ের সর্বশেষতম ঘটনা।
রেজুয়ান বলেন, এই খবর শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। সামরিক বাহিনী যেভাবে আমাদের জমি বাজেয়াপ্ত করছে খুবই অন্যায্য।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আগে, ইন দিন গ্রামে ১৫ একর জমির মালিক ছিলেন মোহাম্মদ। ২০১৭ সালে এই গ্রামে ১০ জন রোহিঙ্গাকে সামরিক বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা রয়টার্স এই হত্যার তথ্য উন্মোচন করে। এই কুখ্যাত ঘটনা প্রকাশের জন্য, দুই স্থানীয় সাংবাদিককে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। নিহতদের মধ্যে দুই যুবক ছিল যাদেরকে ইংরেজি শিখিয়েছিলেন মোহাম্মদ। এ সময় যেখানে সবুজ ইন দিন গ্রাম ছিল এখন সেখানে নাসাকার সীমান্ত ফাঁড়ি। এখানে ১৮০ একরের বেশি জমি দখল করে এটি বানানো হয়েছে। যার মধ্যে ১২৯ একরই রোহিঙ্গাদের।
নির্মূলের প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রচেষ্টা
৩২ বছর বয়সী মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন নাই মাও থেট যিনি মিয়ানমারের বুথিডাং টাইউনশিপে কর্মরত অবস্থায় পক্ষ ত্যাগ করে জান্তা সরকার বিরোধী আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। মাও থেট মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের জন্য সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টা সচক্ষে দেখেছেন। মাও থেটের স্ত্রী ও ৫ বছর বয়সী সন্তান এখন ভারতে বসবাস করে। দলত্যাগের পর মিয়ানমার নাওকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের যেভাবে নির্মূল করা হয়েছে তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি জানান, আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরগুলো অপসারণের জন্য সেনাবাহিনীর এক ইঞ্জিনিয়ার কোরকে বুথিডাং টাউনশিপের এক এলাকায় পাঠানো হয়। তিনি সেই দলে ছিলেন। সেখানে যেয়ে শুধু পোড়া ঘরই তিনি দেখেননি; ওই ঘরগুলোর মধ্যে পুড়ে যাওয়া অনেক দেহাবশেষও তিনি দেখেছেন।
তিনি জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সব প্রমাণ মুছে ফেলতে দেহাবশেষসহ ওই পুড়ে যাওয়া ঘরগুলো বুলডোজার দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। তারা এমনভাবে সেটি করেছে এখন সেখানে গেলে কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট পাওয়া যাবে না।
মাও থেট জানান, সেনাবাহিনীতে চাকরি করা অবস্থায় ১৩ বছরের অর্ধেকের বেশি সময় রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর হয়ে কাজ করেছেন। সেখানে তার ব্যাটালিয়ন রোহিঙ্গা গ্রামগুলি ধ্বংস করে মিয়ানমারের পশ্চিম সীমান্তে সেনাবাহিনীর জমি বাড়ানোর জন্য রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার মিশনে অংশ নিয়েছিল।
তিনি জানান, তিনি চোখের সামনে দেখেছেন মংডু টাউনশিপে সামরিক জান্তা বাহিনী আক্রমণ করেছে, গ্রামে অগ্নিসংযোগ করেছে এবং সব পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। মাও থেট জানান, তিনি গুতারপিন গ্রামে কুখ্যাত একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। যেখানে আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা এপি তদন্ত করে রোহিঙ্গ গণকবর উন্মোচন করেছে।
এপি তার প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কিছু মৃতদেহে অ্যাসিড ঢেলে দেয়া হয়েছিল। এর কারণ হিসেবে মাও থেট বলেন, গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচারের জন্য পরবর্তী কোর্ট মার্শালে অপরাধ আড়াল করার জন্য এটি করা হয়েছিল।
‘ওরা রোহিঙ্গাদের মুছে ফেলতে চায়’
মিয়ানমার নাও জানিয়েছে, জান্তা সামরিক বাহিনী শিগগিরই রহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সকল জমি দখলে নেয়ার পাঁয়তারা করেছে। মাইন হালুটের জমি ছাড়াও, মিও থুগির ১২০ একর, অং সিট পাইনের ২০৫ একর, জিন পাইং নায়ারের ১০৩ একর, আহ লেল চাউংয়ের ৯ একর জমি দখলে নেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
ক্যাপ্টেন মাও থেট জানান, জান্তা বাহিনীর এই পদক্ষেপই প্রমাণ করে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের আচরণের দায় নিতে রাজি নয় বরং রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের আচরণ ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে। তিনি জানান, জান্তা বাহিনী মনে করে রোহিঙ্গারাই সকল সমস্যার উৎস। তারা চায় রোহিঙ্গা আর কোনোদিন ফিরে না আসুক।
এদিকে বালুখালী শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী মাইন হালুট গ্রামের সাবেক প্রশাসক বলেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের একেবারে মুছে ফেলতে চাইছে। তিনি বলেন, আমাদের শিকড়কে উপড়ে ফেলা হয়েছে। তারা আমাদের মানুষ, আমাদের মালিকানা এবং আমাদের সম্প্রদায়কে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।
আবার ফিরে আসা যাক নুরের কথায়। নুরের ভাষায়, ‘আমি মনে করি আমার বাড়ি মিয়ানমারের ওই গ্রামে যেখানে আমি বড় হয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আমি বন্দির মতো আছি। বসবাসের জন্য শরণার্থী শিবিরে জায়গা পেলেও আমার আত্মা পড়ে আছে মিয়ানমারে।’
]]>