Skip to content

রোহিঙ্গা বোঝাই দ্বিতীয় নৌকা পৌঁছেছে ইন্দোনেশিয়া

বেনার নিউজ:

দিনের পর দিন বিকল নৌকায় সাগরে ভেসে থাকার পর শ্রান্ত, বিধ্বস্ত ও অসহায় চেহারা নিয়ে সোমবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের পিডি রিজেন্সির উপকূলে অবতরণ করেছেন অন্তত ১৮৫ জন রোহিঙ্গা।

পুলিশ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে রোহিঙ্গাদের আরেকটি নৌকা সমুদ্রে ডুবে যেতে পারে বলে অনেকে আশংকা করছেন।

দুটি এনজিও বেনারকে নিশ্চিত করেছে, খাদ্য ও পানীয় সংকট নিয়ে তাঁরা প্রায় এক মাস ধরে একটি বিকল নৌকায় সমুদ্রে ভাসছিলেন।

এনজিও সূত্রে জানা গেছে, ভাসমান নৌকাটির অন্তত ২০ জন যাত্রী মারা গেছেন। তারা সবাই বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে আন্দামান সাগর পার হয়ে দক্ষিণে যাত্রা করেছিলেন।

উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে, পিডিতে একজন জেলে বলেছেন, তাঁদের মধ্যে দুই ডজনেরও বেশি লোক নৌকায় মারা গেছেন। অন্যরা তাঁদের মৃতদেহ জলে ফেলে দিয়েছেন।

আচেহ প্রাদেশিক পুলিশের মুখপাত্র উইনার্ডি বলেন, “এই দলে ৮৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, ৭০ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং ৩২ জন শিশু রয়েছে। অসুস্থ উদ্বাস্তুরা চিকিৎসা নিচ্ছেন।”

তিনি এর চেয়ে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানান।

সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় আচেহ প্রদেশে অবতরণ করা দ্বিতীয় নৌকা এটি। গত বড়দিনে কাঠের নৌকায় চড়ে ৫৭ রোহিঙ্গা পুরুষ আচেহ বেসার রিজেন্সিতে পৌঁছেছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) তথ্য অনুসারে তাঁদের মধ্যে ১৩ জন শিশু ছিল।

মনে হচ্ছিল অনেকগুলো নর-কঙ্কাল তীরে হাঁটছে

একজন স্থানীয় বাসিন্দার শেয়ার করা একটি ভিডিওতে সোমবার নারী ও শিশুসহ ১৮৫ জন অভ্যাগত রোহিঙ্গাকে সমুদ্র সৈকতে দুর্বল, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও অবস্থায় দেখা গেছে। বেদনাদায়ক ফুটেজে ভিড়ের মধ্যে কয়েকজনকে কান্নাকাটি করতে শোনা যায়।

স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের নেতা মারফিয়ান বলেন, “এটি পূর্ব বায়ুর মৌসুম হওয়ায় খুব উচ্চ ঢেউয়ের কারণে উদ্বাস্তুরা সমুদ্রে আটকা পড়েছিল। তাদের তথ্য অনুযায়ী ৩০ জন মারা গেছে। লাশগুলো তারা সাগরে ফেলে দিয়েছে। আমরা ঠিক জানি না তারা কতক্ষণ সমুদ্রে ছিল। তবে আমরা তথ্য পেয়েছি, তারা এক মাস আগেও উন্মুক্ত সমুদ্রে ছিল।”

রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন আরাকান প্রকল্পের পরিচালক ক্রিস লেওয়া বলেছেন, ভেসে আসা নৌকার এই যাত্রীরা মিয়ানমারের নাগরিক, যারা এখন রাষ্ট্রহীন।

থাইল্যান্ডে বসবাসকারী লেওয়া সোমবার বেনারনিউজকে বলেন, “আমি এইমাত্র নিশ্চিত হয়েছি আজ সন্ধ্যায় অবতরণ করা সর্বশেষ দলটি সাগরে দুর্দশা কবলিত নৌকাটির যাত্রী।”

মালয়েশিয়ার একটি মানবাধিকার সংগঠন গিউটানিও ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং আন্তর্জাতিক পরিচালক লিলিয়ান ফ্যান বলেছেন, “হ্যাঁ, এটি সেই নৌকা যা উদ্ধারের জন্য আমরা কয়েক সপ্তাহ আগে আহ্বান জানিয়েছিলাম।”

এ দুটি এনজিও সমুদ্রে নৌকাটির গতিবিধির উপর নজর রাখছিল। লেওয়া আটকে পড়া যাত্রীদের আত্মীয়দের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন এবং গুগল ম্যাপের মাধ্যমে নৌকার জিপিএস স্থানাঙ্ক নির্ধারণ করেছিলেন।

ফ্যান সোমবার রাতে বেনারকে বলেন, “যেসব শরণার্থীকে উপকূলে নিয়ে আসা হয়েছে তাঁদের অবস্থা দেখে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।”

“আমি তীরে এই উদ্বাস্তুদের প্রথম আগমনের ভিডিও দেখেছি। দেখে মনে হচ্ছিল অনেকগুলো নর-কঙ্কাল তীরে হাঁটছে এবং সৈকতে ঢলে পড়ছে,” বলেন তিনি।

তীরে পৌঁছানোর পর ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের পিডি রিজেন্সির উজং পাই গ্রামের একটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বিশ্রাম নিচ্ছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। ২৬ ডিসেম্বর ২০২২। [এএফপি]

রোহিঙ্গা ইস্যু মোকাবেলার জন্য আরও সমন্বয় দরকার

সম্প্রতি লেওয়া এবং ফ্যানের সংগঠনসহ অন্যান্য এনজিও এবং জাতিসংঘ মানুষ-পাচারকারী নৌকা এবং এমন বিপজ্জনকভাবে অবৈধ যাত্রার চেষ্টাকারী শরণার্থীদের সন্ধান এবং উদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এই অঞ্চলের সরকারগুলোকে চাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

“সুতরাং, আমি মনে করি যে একটি অঞ্চল হিসাবে আমাদের সত্যিই এই সংকটকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেওয়া দরকার। আমাদের এই বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং ভবিষ্যতের মানবিক বিপর্যয়গুলো প্রতিরোধ করতে হবে।”

সমুদ্রে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য কর্তৃপক্ষ কী করছে তা জানতে বেনারের একাধিক ফোন কল এবং খুদে বার্তার জবাব দেননি উপকূলরক্ষী বাহিনী এবং ফ্যানের দেশ মালয়েশিয়ার নতুন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

প্রতি বছর মিয়ানমারের শত শত নির্যাতিত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে অথবা প্রতিবেশী বাংলাদেশে অবস্থিত শরণার্থী শিবির থেকে পালানোর চেষ্টায় বিপজ্জনকভাবে সমুদ্র পথে যাত্রা করে।

ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকার গোষ্ঠী কনট্রাএস-এর আচেনিজ শাখার প্রধান আজহারুল হুসনা বলেছেন, সোমবার পিডিতে যে দলটি অবতরণ করেছে তাদের মধ্যে শিশু ও মহিলারাও ছিল।

তিনি বেনারকে বলেন, “যারা সমুদ্রে ভাসছে বলে জানা গেছে, এরা সেই দল কিনা আমাদের পরীক্ষা করা দরকার।”

আচেহ পুলিশের মুখপাত্র উইনার্ডি বলেছেন, পুলিশ এখনও শরণার্থীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে।

তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, “রোহিঙ্গা ইস্যু মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে আরও সমন্বয় দরকার। কারণ তাঁদের আগমন বাড়ছে এবং এই ঘটনা আরো ঘন ঘন ঘটছে।”

আইওএম-এর একজন মুখপাত্র আরিয়ানি হাসানাহ বলেছেন, আইওএম থেকে একটি মেডিকেল দল পিডিতে যাচ্ছে।

আরেকটি নৌকা ডুবে যাবার আশংকা

পিডিতে আসা এই নৌকায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি আছেন কিনা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গত সপ্তাহে কক্সবাজারে বেনারের সাথে সাক্ষাতকারে, এই অভিবাসীদের মধ্যে থাকা কয়েকজন বাংলাদেশির পরিবার সদস্যরা তাঁদের সন্তানদের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।

এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে তারা “১৮০ জন রোহিঙ্গাসহ আরেকটি নৌকা সাগরে নিখোঁজ হওয়ার অসমর্থিত প্রতিবেদন পেয়েছে।”

“ঐ নৌকার সাথে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছেন। যারা শেষবার যোগাযোগ করেছিলেন তাঁরা সবাই মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমাদের আশা, এমনটি যেন সঠিক না হয়,” শনিবার এক টুইট বার্তায় জানায় সংস্থাটির এশিয়া-প্যাসিফিক কার্যালয়।

সোমবার যোগাযোগ করা হলে, ইউএনএইচসিআরের আঞ্চলিক মুখপাত্র বাবর বালোচ বেনারকে বলেন, “নিখোঁজ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন এবং সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ভিত্তিতে আমাদেরকে এই তথ্য জানানো হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা এখনও আশা করছি, ঘটনা যেন ওমন না হয়। তবে ইউএনএইচসিআর স্বাধীনভাবে সেই তথ্যগুলো যাচাই করতে পারেনি।”

তবে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, ১৮০ জন যাত্রী নিয়ে সম্ভাব্য ডুবে যাওয়া নৌকাটি সম্প্রতি আচেহ প্রদেশে আসা নৌকাগুলো থেকে আলাদা।

আরাকান প্রজেক্টের ক্রিস লেওয়ার মতে, এই দুটি নৌকায় ভ্রমণকারীরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চারটি দলের মধ্যে ছিলেন, যারা নভেম্বরের শেষের দিকে কক্সবাজার থেকে যাত্রা করেছিলেন।

লেওয়া বলেন, ১৫০ জনেরও বেশি লোক ভর্তি একটি নৌকাকে ভিয়েতনামী এক তেলবাহী জাহাজ মিয়ানমারের উপকূলে ৮ ডিসেম্বর উদ্ধার করে তীরে নিয়ে যায়।

১৮ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী ১০৪ জনকে পরিবহন করা আরেকটি নৌকা উদ্ধার করে।

গত সপ্তাহে একটি নৌকার কাপ্তান, যিনি এখন শ্রীলঙ্কায় আছেন, কক্সবাজারের একটি শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী তাঁর এক আত্মীয়কে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ঐ বার্তায় বলা হয়েছে ডিসেম্বরের শুরুতে অন্য একটি নৌকা হয়তো ডুবে গেছে।

“শ্রীলঙ্কায় থাকা ঐ কাপ্তান বলেছেন, তাঁদের দুটি নৌকা একসাথে কাছাকাছি যাচ্ছিল। সে সময় অন্য নৌকাটির কাপ্তান তাঁকে একটি কষ্টকর কল দিয়েছিলেন,” বেনারকে বলেন লেওয়া।

লেওয়া সোমবার বেনারকে একটি ইমেইলে জানিয়েছেন, “এই কাপ্তান অন্য নৌকার কাপ্তানের কাছ থেকে একটি এসওএস কল পেয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর নৌকাটি ডুবতে চলেছে এবং তাঁর নৌকার যাত্রীদের স্থানান্তর করতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি ঐ নৌকার যাত্রীদের নিতে রাজি হননি, কারণ তাঁর নৌকায় ইতিমধ্যেই ইঞ্জিনের সমস্যা তৈরি হয়েছিল।”

“তাঁর নৌকাটি ইতিমধ্যেই যাত্রীর ভারে উপচে পড়ছিল এবং তিনি আশঙ্কা করেছিলেন ঐ নৌকার যাত্রীদের নেওয়ায় চেষ্টা করলে সবাই ডুবে যাবে।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কুয়ালালামপুর থেকে নিশা ডেভিড, ব্যাংকক থেকে নানতারাত পাইচারয়েন, এবং ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ইমরান ভিটাচি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *