<![CDATA[
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের জ্যেষ্ঠ পলিসি অ্যাডভাইজার ডেরেক শোলে বাংলাদেশ সফর করে ফিরে গেছেন তার দেশে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের বছর তার এ সফর হয়তো একেবারে উদ্দেশ্যহীন নয়। সে কারণেই কৌতূহল চারদিকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডেরেকের সফরে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস), দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি এজেন্ডার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো ফাঁফা বুলি ছাড়া কিছুই নয়।
তাদের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশকে মার্কিন ব্লকে টানা ও দেশের কোনো এক বা একাধিক গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন এ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য। আর এ জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলো সামনে এনে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এর মধ্যে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেসবুক পেজে দেয়া একটি রহস্যজনক স্ট্যাটাস সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে।
কী আছে স্ট্যাটাসে
১১ ফ্রেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পেজে দেয়া ওই স্ট্যাটাসে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের নেতা এ ফিলিপ র্যানডলফের একটি উক্তি তুলে ধরা হয়।
স্ট্যাটাসে বলা হয়, ‘কোনো জাতিগোষ্ঠী, জাতি বা শ্রেণির মুক্তি অবশ্যই তাদের ভেতর থেকেই আসতে হয়। স্বাধীনতা কখনো দেয়া হয় না, তা জয় করতে হয়। ন্যায়বিচার কখনো দেয়া হয় না, সেটা আদায় করে নিতে হয়।’
মার্কিন দূতাবাসের এ স্ট্যাটাসকে দেশের একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ বার্তা বা উসকানি বলেও মনে করছেন অনেকে।
আরও পড়ুন : মিয়ানমার ইস্যুতে পশ্চিমের এ কেমন দ্বিচারিতা?
এ বিষয়ে রাজনীতি বিশ্লেষক ড. জাহেদুর রহমান বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনি এমনি কিছু করে না। তাদের প্রতিটি কাজের পেছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে।
ডেরেক শোলের সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইন্দো প্যাসিফিক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত চাপ রয়েছে। যিনিই সফরে আসছেন, তিনিই এ বিষয়ে চাপ দিচ্ছেন। একই সঙ্গে শোলের সফরে মিয়ানমারের জাতীয় সরকারকে সমর্থন ও সামরিক জান্তাকে সরিয়ে ফেলতে সহায়তা করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তারা চাচ্ছে বাংলাদেশ তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) পক্ষে যোগ দিক।
‘আমরা ধরে নিতে পারি, ভবিষ্যতে একটার পর একটা একই ধরনের সফর অনুষ্ঠিত হবে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু চাওয়ার জায়গা আছে এবং সেসব চাওয়ার কতটুকু বাংলাদেশ পূরণ করছে সেটাই মুখ্য,’ যোগ করেন তিনি।
পশ্চিমা নেতাদের ঘনঘন ঢাকা সফর
গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের রাজধানীর শাহীনবাগে নিখোঁজ এক বিএনপি নেতার বাসায় যাওয়া এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করে। ওই ঘটনার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করেন। অনেকেই তখন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে এ নিয়ে দুদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
তবে চলতি বছরের শুরু থেকে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক হঠাৎ যেন ভিন্ন গতি পায়। জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লুবাচের বাংলাদেশ সফর করেন।
আরও পড়ুন : ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না: প্রধানমন্ত্রী
এর ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা সফরে আসেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তার সফরের পরই টানাপোড়েনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ইতিবাচক দিকে মোড় নেয়।
এরপর ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রমবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কারা সি ম্যাকডোনাল্ডের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ সেই সফর বাতিল করা হয়।
এরপরই সফরে এলেন ডেরেক শোলে। শোলের এ সফরকে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কেন আসেন তারা
পশ্চিমা দুনিয়ার কোনো নেতা যখনই বাংলাদেশ সফরে আসেন তখনই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাণিজ্য বা সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলা হয়। কিন্তু এমন সফরগুলো কেন, বিশেষ করে নির্বাচনী বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়?
বিশ্লেষকদের মতে, মুখে তারা যাই বলুক, নির্বাচনী বছরগুলোতে পশ্চিমা দুনিয়ার বড় বড় কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফরে আসেন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। চলতি বছরের শেষ অথবা আগামী বছরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমন সময়ে পশ্চিমা নেতাদের বাংলাদেশ সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন : বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাসের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নির্বাচনের বছর হিসেবে কোনো পশ্চিমা নেতা বাংলাদেশ সফরে এলেই নির্বাচনী আলাপ হবে এটা কিছুটা সত্য। এ ব্যাপারে তারা কিছুটা চাপও দিতে পারে। তবে নির্বাচন, মানবাধিকার মুখ্য বিষয় নয়। বরং এই সফরকে পশ্চিমাদের নিয়মিত সফর বলা যায়। বাংলাদেশ এরই মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে, সার্বভৌম দেশ হিসেবে নিজের একটা কাঠামো দাঁড় করিয়েছে। এখন পশ্চিমা দুনিয়ার উচ্চপদস্থরা নিয়মিত ঢাকা সফর করছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের সফর আরও বাড়বে।
তিনি বলে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য বিনিয়োগ, অস্ত্র বিক্রি এবং বাংলাদেশকে ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলের অংশীদার করা।
মার্কিন রাজনীতির চরিত্র
মার্কিন ইতিহাসবিদ পল অ্যাটউডের একটি মাত্র উক্তি দিয়ে মার্কিন রাজনীতির চারিত্রিক দিক অনেকাংশেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। তার মতে, ‘যুদ্ধ হলো আমেরিকান জীবনযাত্রা। জন্ম, বেড়ে ওঠার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তিও হয়ে উঠেছে যুদ্ধ, দাসত্ব এবং মানবহত্যা থেকে।’
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব অসংগঠিত গণতান্ত্রিক রেকর্ডের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ অজুহাতে বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধ চালাচ্ছে এবং নিজেদের অসংখ্য অপরাধ এড়িয়ে যাচ্ছে। তারাই মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়ে সার্বভৌম শৃঙ্খলা ধ্বংসের মাধ্যমে বিশ্বশান্তিকে হুমকিতে ফেলছে। একইসঙ্গে যুদ্ধ রফতানি, চরমপন্থি মতাদর্শ এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা উসকে দেয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে রক্তপাত ও অশান্তির অসংখ্য পথ তৈরি করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ‘গণতন্ত্রের মডেল’ তার উজ্জ্বলতা হারালেও এখনও তথাকথিত গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলনের নামে একচেটিয়া চক্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে দেশটি।
আরও পড়ুন : বলছেন বিশ্লেষকরা /যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক মনোভাব সুসম্পর্ক বজায় রাখার ইঙ্গিত
একটি পরিসংখ্যান থেকে মার্কিন রাজনীতির চরিত্রের কিছুটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর যুক্তরাষ্ট্র গত ২৪০ বছরে মাত্র ১৬ বছর কোনো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না। পরিসংখ্যান বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৫৩টি স্থানে সংঘটিত ২৪৮টি সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে ২০১টি শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যা মোট সংঘটিত যুদ্ধ-সংঘাতের ৮০ শতাংশেরও বেশি। এসব যুদ্ধে নিহত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ, অসংখ্য মানুষ হয়েছেন বাস্তুচ্যুত।
সফর কি ব্যর্থ হয়েছে
এমন পরিস্থিতিতে ডেরেক শোলের ঢাকা সফর কতটা সফল হয়েছে, দেশের রাজনৈতিক মহলে সেই প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শোলের এই সফরের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়নি।
এ বিষয়ে ড. ইমতিয়াজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে মিয়ানমার গণহত্যা করেছে। এখন সেখানে (মিয়ানমার) যা চলছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সে লক্ষ্যে তারা জাতীয় সরকারকে সমর্থনও দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো জানতে চেয়েছিল আমরা প্রকাশ্যে পশ্চিমাদের হাতে হাত মিলিয়ে মিয়ানমারের জাতীয় সরকারকে সমর্থন করব কি না।’
তিনি বলেন, ‘তবে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশ এখানে গুরুত্বপূর্ণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসলে প্রতিবেশী বদলানো যায় না। প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝামেলা করে সামনে এগোনো খুবই কঠিন। বাংলাদেশ আসলে ওই ঝামেলায় জড়াতে চায় না।’
‘বরং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনায় গাম্বিয়া যে মামলা করেছে, সেটিতে তারা সমর্থন করুক, অর্থ দিক,’ বলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
]]>