Skip to content

সবার লাভ, ক্ষতি কার? | মুক্তকথা

সবার লাভ, ক্ষতি কার? | মুক্তকথা

<![CDATA[

গরিব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহ হলে, তারা না চাইলেও প্রতিবেশি ধনী মোড়ল তা নিয়ে বিচার সালিশ বসান। এই বিচারের নামে মোড়ল একটি পরিবারে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে জোর করে নাক গলান। কখনো কখনো বিবাহ বিচ্ছেদের রায় দেন। আর গরিবের স্ত্রী যদি সুন্দরী হন তাহলে মোড়ল তাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য করে নিজেই প্রয়োজনে চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে সমস্যার সমাধান করে দেন।
পরে খোঁজ নিলে দেখা যায়, ওই নারীর প্রতি আগ্রহের কারণে মোড়ল নিজেই নানা কু-পরামর্শ দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ তৈরি করেছেন। আবার দুই গরিব প্রতিবেশীর মধ্যে জমিজমা নিয়ে কৌশলে বিরোধ লাগিয়ে সেই জমি কম দামে কিনে বা দখল করে নেয়ার নজীরও আছে মোড়লদের মধ্যে।

এই মোড়লিপনা আছে বিশ্ব রাজনীতিতেও আছে । স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিশ্বে পরাশক্তি ছিল দুইটি। কিন্তু রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর এখন বিশ্বের একক মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে তার ওপরে আর কথা নেই। আর তারা যা করে তাদের পারিষদবর্গও তা অনুসরণ করে।

বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নতুন ভিসা নীতি প্রকাশের পর এখন সেটা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। আলোচনা দেখে আমার মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন আইনগতভাবে বিভিন্ন দেশের ব্যাপারে নানা সিদ্ধান্ত দিতে পারে। আর সেটা আমরা মানতে বাধ্য। তারা যেন বিশ্ব সংবিধানের রক্ষক এবং বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছে। তাই তাদের ব্যাপারে কোনো কথা নেই। কথা হচ্ছে এখানকার নানা পক্ষের মধ্যে। এর জন্য কে দায়ী তা বিশ্লেষণ হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যা বলছে তা হলে সহীহ। সেটা তো মানতেই হবে।

যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি করেছে সেটা সে করতেই পারে। সে যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয় সেটাও তার ব্যাপার। সেটা তার রাষ্ট্রের ব্যাপার। একাটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা কীভাবে চলবে সেটা সেই দেশের ব্যাপার। তাতে আরেকটি দেশ লাভ বা ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু ওই রাষ্ট্র যা করেছে তা যে ঠিক করেছে সেটা আমাদের বলতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। এটা মানতেই হবে এমন বিষয়ও নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারটি হলো বাস্তবতা। এটা তার ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক শক্তির কারণে। শক্তিমানের অনৈতিক বা অন্যায় কাজ নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষ সমালোচনা করলেও যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকেন বা যেতে চান তারা কিন্তু কিছু বলেন না। তারা হয় চুপ থাকেন বা ‘সহমত ভাই’ হয়ে যান।

তাই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিতে বাংলাদেশের সরকার, আওয়ামী লীগ, বিএনপি সবাই লাভ দেখছেন। সবাই বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে গেছে। আওয়ামী লীগ বলছে তাদের পক্ষে গেছে। বিএনপি বলছে তাদের পক্ষে গেছে। তাহলে তো দুই বড় দলের মধ্যে ঐকমত্যও হয়ে গেল। আমার প্রশ্ন এতে যদি সবার লাভ হয়, ক্ষতি কার?

বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিতে কী আছে আমার মনে হয় যারা সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফলো করেন, তাদের এরইমধ্যে জানা হয়ে গেছে। এটা নিয়ে প্রধান দুই দলের প্রতিক্রিয়াও তারা জানেন। ভিসানীতির মোদ্দা কথা হলো, যারা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করবেন তাদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এরমধ্যে শুধু ভোট গ্রহণ নয়,পুরো প্রক্রিয়াকেই তারা দেখবে। রাজনৈতিক দলের সদস্য ছাড়াও  বর্তমান এবং সাবেক সরকারি কর্মকর্তাও এর আওতায় পড়বেন। তবে নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হবে, না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। আর কোনো দল নির্বাচনে না গেলে সেটা সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যাপার  বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা দেখবে কারচুপি, সভা সমাবেশে বাধা, নির্বাচনে বাধা দেয়ার কোনো চেষ্টা, সহিংসতা এসব।

তাদের এই উদ্দেশ্য দেখে এরমধ্যে তাদের মহত্ব খুঁজে পেতে পারেন কেউ কেউ। বলতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের জন্য, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। এমন পরোপরকারী দেশ আর বিশ্বে নেই!

কিন্তু আমার মনে হয়, এটা একটি দেশের মধ্যে ঢোকার যুক্তরাষ্ট্রীয় কৌশল। ওই গ্রাম্য মোড়লের মতো। ঢোকার পথ তৈরি করেছে। এবার জেঁকে বসার পালা। কারণ তাদের এই ভিসানীতি বাস্তবায়ন করতে এখানে তাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে। অনেক তথ্য নিতে হবে। শুধু দূতাবাস দিয়ে সেই কাজ হবে বলে আমার মনে হয় না। আর তারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা কিন্তু তারা যা মনে করেন তাই। এটা নিয়ে কিন্তু আর কারুর কিছু বলার থাকবে না। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রই অভিযোগকারী,সে-ই আবার বিচারক।

আমি অবাক হয়েছি, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টুইট বার্তায় ভিসা নীতি প্রকাশের পরদিন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিরা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কাছে দৌড়ে গিয়েছেন। এই তিনটি দলকেই আমার মনে হয়, তিনি সুযোগ দিয়েছেন। আরো সুযোগ দিলে পিটার হাসকে জনসভা করতে হতো বলে মনে করি। আর সেখানে গিয়ে সব দলই খুশি হয়ে চলে এসেছেন। সব দলই নতুন নীতিকে স্বাগত জানিয়ে যার যার লাভের কথা এখন বলছেন। কিন্তু তারাও জানেন, আসলে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী চায়। তারা কোন চুক্তি ও সুবিধা নিতে চায় বাংলাদেশ থেকে। তাদের টার্গেট কী? যুক্তরাষ্ট্রর খেলা হলো কার কাছ থেকে এই সুবিধা তারা পাবে। যার কাছ থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে তাকে চাপে রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। সেটা কখনো নির্বাচনের নামে। কখনো গণতন্ত্রের নামে।

 

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনা সরকারের ওপর আস্থা আছে যুক্তরাষ্ট্রের: পিটার হাস

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কর্মশালার বাস্তব ফল আমাদের চোখের সামনেই আছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কর্মশালার ফলতো আমরা চোখেই দেখতে পাচ্ছি। এই কর্মশালা তারা আরো বাড়াতে চাইবে। কারণ কর্মশালা না বাড়ালে তাদের নিয়ন্ত্রণ তো আরো শক্ত হবে না। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে কর্মশালার লাভের টাকা তুলছে।

 

ডলারকে আরো আধিপত্যবাদী মুদ্রায় পরিণত করেছে। রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞাও তার সুবিধামতো। আমরা রাশিয়ার তেল নিতে পারি না। ভারত নিতে পারে। তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আলাদা আইন করেছে। সেই তেল আবার ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিতে পারে। রাশিয়ার গ্যাস নিতে ইউরোপের সমস্যা নেই। আমরা গমও নিতে পারব না।

তবে সুযোগটি আমরাই করে দেই। একটি দেশের নির্বাচন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেই দেশের রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদেরই দেখার দায়িত্ব। সেই দেশের সংবিধান তারাই সমুন্নত রাখবেন। কিন্তু বাংলাদেশে বার বার সেটা বাধার মুখে পড়েছে। বার বার সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। সামরিক একনায়করা এখানে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে। ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতা পোক্ত করেছে।

আর এর সুযোগ নিয়ে এখানে গণতন্ত্রের ছবক দিতে এসে যুক্তরাষ্ট্র তার সুবিধাই খুঁজেছে। সুবিধার জন্য এখন যেমন নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে, অতীতে আবার সামরিক শাসকদের পক্ষে কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে গণতন্ত্র বা সুষ্ঠু নির্বাচনের বাণী শুনলে তাই আমি ভয় পাই। মনে রাখতে হবে, তারা কিন্তু  কখনো অর্থ পাচারকারী,দুর্নীতিবাজ বা যুদ্ধাপরাধীদের ভিসা না দেয়ার কথা বলেনি। উল্টো তাদের আশ্রয় দিচ্ছে।

নির্বাচন নিয়ে দেশে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমাধান করতে হবে। সরকারকেই সবার আগে উদ্যোগ নিতে হবে। অনঢ় অবস্থান থেকে সবাইকে সরে আসতে হবে। সংঘাত-সংঘর্ষ যুক্তরাষ্ট্রকে মোড়ল হিসেবে আরো জেঁকে বসতে সহায়তা করবে। তখন তার বাংলাদেশ থেকে সুবিধা নিতে আরো সহজ হবে।

তাই সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে লাভ না খুঁজে দেশের কথা ভাবুন। এখানে গণতন্ত্রের চাষ করতে যুক্তরাষ্ট্রর মতো মোড়লকে চাষী হিসেবে আনলে সেই ফসল কিন্তু আমাদের ঘরে আসবে না। তারা সুদে আসলে কয়েক গুণ বেশি নিয়ে যাবে। আমাদের তিমির রাত্রি আরো দীর্ঘ হবে।
আরেকটি কথা বলি। এখন বিতর্ক হচ্ছে যে মার্কিন ভিসা নীতির কথা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ৩ মে জানিয়েছে সেটা ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর টুইট বার্তার আগে কেন আমাদের সরকার জানাল না। তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র? তাদের কথা তারাইবা জানাতে দেরি করল কেন? দয়া করে দেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাব-পোস্ট অফিসে পরিণত করার চেষ্টা করবেন না। সরকারের বিরোধিতা করুন। সরকারের বিরুদ্ধে বলুন, সমালোচনা করুন। তবে দেশের সম্মান নষ্ট করবেন না। সরকার আর দেশ এক নয়।

 

]]>

সূত্র: সময় টিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *