<![CDATA[
একটা সময় ছিল যখন ছোট থেকে তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা কিংবা বাকের ভাইকে দেখে কিশোররা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখত, আশা জাগাত নতুন সমাজ গঠনের। কিন্তু গত কয়েক দশকের ব্যবধানে তামিল, বলিউড, হলিউডসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সিনেমার সহজলভ্যতা ও এর প্রভাবে হিরো হওয়ার নেশায় বদলে গেছে কিশোরদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য। কখন জানি সিনেমার হিরো হতে গিয়ে বাস্তব জীবনে ভিলেন হয়ে উঠছে তারা।
বর্তমান সময়ে সিনেমার পর্দায় হলিউড-বলিউড কিংবা তামিল হিরো মানেই অপরাধ জগতের তুখোড় খেলোয়াড়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, কথার তুবড়ি ছোটানো, অস্ত্রের ঝনঝনানি আর নায়িকাকে পটাতে ইভটিজিং করা যেন হয়ে উঠেছে হিরোর বৈশিষ্ট্য। আর বর্তমান সমাজের তরুণদের আইকন হয়ে উঠছে এসব হিরো। সিনেমার পর্দায় এসব হিরোর কর্মকাণ্ড অনুসরণ করতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই অবক্ষয়ের পথে হাঁটছে কিশোররা।
আরও পড়ুন: রাজধানীতে সক্রিয় ৫২ কিশোর গ্যাং
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জানান, কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও আচরণে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সিনেমা, নাটক ও সিরিজ প্রভাব বিস্তার করছে। এখন প্রযুক্তির সহায়তায় ইউটিউবে বা অন্য কোনো সাইটে যে কেউ চাইলেই সিনেমা বা সিরিজগুলো দেখে নিতে পারে। এখন এসব কাল্পনিক মুভি দেখে যদি কিশোররা সে রকম আচরণ করতে থাকে, তাহলে সমাজের মধ্যে একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে। এ ধরনের চলচ্চিত্রগুলো আসলে একটা দেশের কিশোরদের মধ্যে একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য তৈরি করে দেয়।
‘কাল্পনিক বা অবাস্তব এমন কোনো কিছু দর্শকের সামনে নিয়ে আসা উচিত নয়, যা সংস্কৃতিতে আমরা লালন করি না। ভারতের একেক রাজ্যের চলচ্চিত্রের ধরন একেক রকম। বিশেষ করে তামিল মুভির একটা প্রভাব আছে দেশে। এ ছাড়া বলিউডের মুভিগুলোতে অতিকাল্পনিক ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মারপিটের যেসব বিষয় সংযোজন কর হয়, সেগুলোর অনেক বিছু কিশোররা জানেই না। উদাহরণ টেনে বলা যায়, যখন ক্রিশ সিনেমাটি মুক্তি পায় তখন ভারতে কয়েকজন তরুণ ভবনের ছাদে উঠে লাফ দিয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, সিনেমা থেকে তরুণরা কতটা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে,’ যোগ করেন তৌহিদুল হক।
প্রতিটি সিনেমাতেই ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয় থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদি কিশোররা নেতিবাচক কাঠামোটাকে বেশি গ্রহণ করে, তাহলে আমাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে। রাষ্ট্র চাইলেই এ বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে পারবে, সেই সক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো যে আমাদের এ বিষয়গুলো মেনে নিয়েই কাজ করতে হয়।’
আরও পড়ুন: খুলনায় বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য
রাষ্ট্র বা সরকার দিনশেষে সংখ্যার ভিত্তিতে হিসাব করবে যে কতজন কিশোর অপরাধের কারণে গ্রেফতার হলো, কতজন মারা গেল বা কতগুলো ঘটনা ঘটল। তবে পরিবারের জন্য একটি কিশোর বা সন্তান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার কিন্তু পরিসংখ্যান হিসেবে বিচার করবে না। তারা তাকে একজন সদস্য হিসেবেই বিচার করবে। কারণ, একজন সদস্যের ওপর পরিবারের আর্থিক বা পারিবারিক কাঠামো নির্ভর করে।
শুরু থেকেই পরিবারকে সচেতন হওয়ার ভূমিকা পালন করতে হবে জানিয়ে তৌহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশের চরম বাস্তবতা হচ্ছে, সন্তানকে এই বিষয়গুলোতে সচেতন বা সক্রিয় করে, একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে বড় করার অনুকূল পরিবেশ দেয়ার সক্ষমতা সব পরিবারের নেই। আরও অনেক কিছু বাস্তবতা আমাদের মধ্যে আছে। তবে সন্তানকে কীভাবে সুপথে ফিরিয়ে আনা যাবে, সে বিষয়ে যদি পরিবারগুলোকে শিক্ষা দিতে বা সচেতন করতে পারি, তাহেলে কিছুটা হলেও ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করা হবে।’
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা লাইফস্প্রিংয়ের সাইকিয়াট্রিস্ট হাসিবুল আজিম আকাশ বলেন, ‘প্রতিটি মুভি আমাদের মধ্যে একটা তাড়না, একটা অনুকরণের বিষয় তৈরি করে। যেটা কিশোরদের মধ্যে বেশি থাকে যে আমি এর মতো করে কাজটি করব বা এমন হব। সাউথ ইন্ডিয়ান বা ওই ধরনের মুভি বিভিন্ন ধরনের ভায়োলেন্স বা এডাল্ট সিন দেখাচ্ছে, যা নির্দিষ্ট বয়সের আগে দেখা উচিত নয়। যদি এ বিষয়গুলো আপনি অল্প বয়সেই হাতে পেয়ে যান, তাহলে আপনার মধ্যে কিন্তু একটা অন্য ধরনের ফিলিংস তৈরি হবে। আপনিও সেই হিরো বা চরিত্রের মতো করে ভাবা শুরু করবেন। পাশাপাশি কিছু অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট থাকে ইন্টারনেট বা বিভিন্ন মিডিয়ায়, যেগুলো আসলে মানুষের জন্য উপযোগী নয়।’
আরও পড়ুন: কিশোর গ্যাং বাড়ার কারণ জানালেন ডিএমপি কমিশনার
প্রতিটি মুভি দেখানোর আগে একটা সতর্ক বাণী দেয়া থাকে যে মুভিটি কত বছর বয়সের বাচ্চাদের বা কত বছর মানুষের জন্য দেখার উপযোগী। এটা খেয়াল রেখে মুভি দেখতে হবে। তবে মুভি দেখা বন্ধ করতে হবে এটা বলা যাবে না; প্রয়োজনে মুভিগুলো ফিল্টারিং করা যেতে পারে। একজন অভিভাবক হিসেবে বাবা-মাকে এটা করতে হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
]]>