Skip to content

ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের টানা এক যুগ: নিশ্চিহ্ন প্রায় বিরোধীদল

  • by
khaleda.JPG

বেনার নিউজ:

নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করার সমালোচনা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বেগবান করার প্রশংসা নিয়ে টানা এক যুগ পার করল আওয়ামী লীগের শাসনামল। 

এই সময় দেশ থেকে কার্যকর বিরোধী দল প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার জন্য সরকারের দমন-পীড়নকে দায়ী করছে বিএনপি। যদিও সরকারের মতে, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও জনসমর্থন কমে যাওয়ার কারণেই প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে বিরোধী দল। 

প্রায় দুই বছর সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের শাসন শেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনই ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সর্বশেষ নির্বাচন। 

এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট। এরপর আরো দুটি সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ পার করল টানা শাসনের এক যুগ। এর আগে ১৯৯৬ সালেও এক মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। 

২০০৮ সাল থেকে টানা ১২ বছরের শাসনকালে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য এসেছে। দারিদ্র কমেছে। বাংলাদেশ কয়েক বছরের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। উন্নত হয়েছে দেশের অবকাঠামো। নির্মাণ হয়েছে পদ্মাসেতুর মতো মেগা প্রকল্প। চলছে মেট্রোরেলসহ আরও অনেক বৃহৎ প্রকল্পের কাজ।

“বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্বের দরবারে আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে,” টানা শাসনের যুগপূর্তি উপলক্ষে মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভার প্রারম্ভিক ভাষণে বলেন বাংলাদেশের চার বারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। 

টানা তিনবার নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে পেরেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা সরকারে থাকি বা যারাই থাকুক, তারা যদি এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তাহলে বাংলাদেশকে আমরা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।” 

বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি আয়োজিত জনসভার ভিডিও নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করছেন এক দর্শক। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮। [কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

নিশ্চিহ্ন বিরোধী দল ও গণতন্ত্র

টানা এক যুগ আওয়ামী লীগ শাসনকালে বাংলাদেশে “অর্থনৈতিকভাবে অনেক অগ্রগতি” অর্জিত হলেও “গণতান্ত্রিক দিক থেকে দেশ এগিয়েছে তা বলা যাবে না” বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বেনারকে বলেন, “দেশে কার্যত কোনো বিরোধীদল নেই। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকলে দেশের গণতান্ত্রিক পরিচয় শেষ হয়ে যায়।”

বাংলাদেশের তিন বারের শাসক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, “একটানা ১২ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় প্রধান ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের। দেশে আর গণতন্ত্র নেই। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে।”

তিনি বলেন, “দেশের মানুষ তাঁদের পছন্দমতো নেতা নির্বাচন করতে পারেন না। নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের তাবেদারে পরিণত হয়েছে।”

“দেশে এখন একনায়কতন্ত্র চলছে,” মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, “কোনো সভা সমাবেশ করার অধিকার নেই। কথা বলার অধিকার নেই। কেউ একটু কিছু বললেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হতে হয়।”

“দেশে সরকারকে জবাবদিহি করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। …বিএনপির শত শত নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে। দেশে কোনো বিচার নেই, কোনো মানাবাধিকার নেই,” বলেন মির্জা ফখরুল।

তবে “দেশে কথা বলার বা সমাবেশের অধিকার নেই কথাাট ঠিক নয়,” মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “প্রতিদিন বিভিন্ন সংগঠনসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে।”

তিনি বলেন, “তারা (বিএনপি) আগুন সন্ত্রাস ও বোমাবাজির মাধ্যমে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন (২০১৪) ঠেকাতে চেয়েছিল। …২০১৫ সালে আরেক দফা বোমাবাজি ‍ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশে নৈরাজ্য কায়েম করে জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়।”

“শেখ হাসিনা যা করেছেন তা হলো, গণতন্ত্রের নামে বিরোধীদলের সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি কঠোর হাতে দমন করেছেন। তাঁরা যদি সহিংসতার অধিকার চান তা তাঁদের দেয়া হবে না,” বলেন শাজাহান খান। 

“বিএনপি নিজেদের ভুলে নিশ্চিহ্ন,” মন্তব্য করে শাজাহান খান বলেন, “দেশের মানুষ তাদের আহ্বানে সাড়া দেয় না—এটা কি আমাদের দোষ?”

“তবে দেশে শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকায় সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,” বলে মনে করেন তিনি।

“কারণ জনগণের কথা বিরোধীদল বলে থাকে। আমরা চাই বিএনপি সংসদে ও সংসদের বাইরে শক্তিশালী বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করুক,” বলেন শাজাহান খান।

অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদের মতে, “সরকারের উচিত বিরোধীদল যাতে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করা। এছাড়া, দলের ভেতরেও গণতান্ত্রিক চর্চা বৃদ্ধি করা উচিত।” 

হেফাজতের উত্থান

দেশে কট্টরপন্থী ও মৌলবাদী জোট হেফাজতে ইসলামের উত্থান আওয়ামী লীগের টানা ১২ বছর ক্ষমতার একটি অন্যতম দিক বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান। 

তাঁর মতে, এই ইসলামী মৌলবাদী সংগঠনের রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো গণতন্ত্র চর্চার জন্য “একটি অশনি সংকেত।”

তিনি বলেন, “হেফাজতে ইসলামীর উত্থানের কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও দুর্বল হবে। এই গ্রুপের কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিচয় সংকটের মুখে পড়েছে।”

এছাড়া বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনীতিকরা নয়, বরং আমলা ও ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই অবস্থার অবসান দরকার।”

“সংসদে বিরোধীদলকে আরও সুযোগ দিতে হবে। সংসদকে কার্যকর করতে হবে,” যোগ করেন তারেক শামসুর রেহমান। 

এক নজরে এক যুগ

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান সংশোধন বিল পাশের মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে শুরু হয় বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলন। পাশাপাশি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে তারা। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। 

১৯৯১ সালের পর প্রথমবারের মতো বিএনপির প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই গঠিত হয় জাতীয় সংসদ। সংসদে প্রধান বিরোধীদলের দায়িত্ব পায় জাতীয় পার্টি, যারা একইসঙ্গে সরকারের অংশ হিসাবে দায়িত্ব পালন করে।

২০১৫ সালে সহিংস উপায়ে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের আন্দোলন শুরু করে ব্যর্থ হয় বিএনপি। পাকাপোক্ত হয় শেখ হাসিনার শাসন।

২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারারুদ্ধ হন খালেদা জিয়া। নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হয়ে পড়েন তিনি।

দলের প্রধান হন তাঁর পুত্র তারেক রহমান যিনি ২০০৭ সাল থেকে ব্রিটেনে অবস্থান করছেন। 

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। একক সংখ্যার আসনে জয় লাভ করে বিএনপি। আবারও সংসদে প্রধান বিরোধীদল হয় জাতীয় পার্টি। 

মুক্তচিন্তা ও বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ

২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করে আওয়ামী লীগ। এই আইনের আওতায় কোনো প্রকার ওয়ারেন্ট ছাড়াই কম্পিউটার সিস্টেম পরীক্ষা করাসহ বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেয়া আছে সরকারকে। 

নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই আইনকে ২০০৬ সালের তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার চেয়েও বিপদজনক বলে অভিহিত করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছে।

বাংলাদেশের সম্পাদক পরিষদ এই আইন বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করেছে। এই আইনে অনেক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এই আইনের শিকার সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল এখন আলোচিত নাম। গুমের শিকার হয়ে প্রায় দুই মাস অজ্ঞাতবাসের পর ফিরে এলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলায় আটক হয়ে তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়েছে সাত মাস।

আদালত ১৪ বার তাঁর জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন কাজল।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ২১৯ জন সংবাদকর্মী হামলার শিকার হয়েছেন।