জামিনে মুক্ত হয়ে নয়দিন পর পরিবারের কাছে ফিরেছেন রোহিঙ্গা আলোকচিত্রী আবুল কালাম। সোমবার তাঁর জামিন মঞ্জুর করে কক্সবাজারের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, আনুষ্ঠানিকতা শেষে বুধবার কারাগার থেকে ছাড়া পান তিনি।
দুপুর একটার দিকে ছাড়া পাবার পর কালামকে পুলিশের দায়িত্বে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের নেতা বা মাঝিদের “জিম্মায়” রেখে আসা হয়েছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার জেলা কারাগারের ডেপুটি জেলার মনির হোসেন।
কালামকে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সুরক্ষা দলের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান কুতুপালং শিবিরের ক্যাম্প-ইন-চার্জ (সিআইসি) মো. খলিলুর রহমান।
কক্সবাজার থেকে ভাসানচরগামী শরণার্থীদের ছবি তোলার সময় গত ২৮ ডিসেম্বর আটক হন কালাম। এর তিন দিন পরে সরকারি কাজে বাধাদান ও কর্মকর্তাদের ওপর হামলায় ঘটনায় মে মাসে দায়ের হওয়া পুরোনো একটি মামলার এক অজ্ঞাতনামা পলাতক আসামি হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।
মুক্ত হলেও এখন তিনি ‘অনিরাপদ’ বোধ করছেন বলে বেনারকে জানান আবুল কালাম।
শরণার্থী শিবিরে নিজের ঘর থেকে বুধবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে তিনি বেনারকে বলেন, “পরিবারের সদস্যদের মাঝে ফিরে এসে খুবই ভালো লাগছে। তবে এখন আমি এখানে অনিরাপদ বোধ করছি।”
অনিরাপদবোধের কারণ জানতে চাইলে সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো “পরিস্থিতিতে নেই” বলে দাবি করেন কালাম।
“ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে তাঁকে যেভাবে আটক করে ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এতে তিনি আতঙ্কিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কোনো শরণার্থীকে এভাবে হেনস্থা করা মোটেই কাম্য নয়,” বেনারকে বলেন ঘটনার শুরু থেকে পর্যবেক্ষণকারী মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
তবে সিআইসি খলিলুর রহমানের মতে রোহিঙ্গা কালামের কাছে বাংলাদেশের অবৈধ জাতীয় পরিচয়পত্র থাকাটা যে “কত বড়ো অপরাধ” তা কালাম নিজেও ভালোভাবে জানেন। নিজের সেই অপরাধবোধের কারণেই কামাল আতঙ্কিত।
বেনারের কাছে কালামের কাছ থেকে উদ্ধার করা বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি ছবি রয়েছে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি কালাম।
এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর কালামের স্ত্রী সৈয়দা বেগম তাঁর স্বামীর বাংলাদেশি পরিচয়পত্র থাকার কথা বেনারকে নিশ্চিত করে বলেছিলেন, তাঁর স্বামী সেটি কীভাবে পেয়েছেন তা তাঁর জানা নেই।
‘তিন দিন আটক রাখা হয়’
গত ২৮ ডিসেম্বর কুতুপালং থেকে ভাসানচরগামী রোহিঙ্গারা রওয়ানা দেবার সময় তাঁদের বহনকারী বাসের ছবি তোলায় “কোনো কারণ ছাড়াই ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি) আমাকে ধরে নিয়ে যান,” বলে বেনারকে জানান কালাম।
কালাম জানান, ধরে নেবার পর সিআইসি নিজের কক্ষে তাঁকে “তিন দিন আটকে রাখেন। এরপর পুরানো এক মামলায় জড়িয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন।”
কালামকে ৩১ ডিসেম্বর সকালে সিআইসির পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় বলে এর আগে বেনারকে জানিয়েছিলেন উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন।
কালামের গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ওই দিন দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে দেশ-বিদেশের ৩৩ জন মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক দাবি করেছিলেন, আটকের পর কালামকে মারধর করা হয়েছে।
তবে কালাম জানান, তাঁকে কোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি।
তিনি বলেন, “গত মে মাসের যে ঘটনার মামলায় আমাকে জড়ানো হয়েছে, সে সম্পর্কে আমি ঠিক মতো জানতামও না। ঘটনাটি আমাদের শিবির থেকে কমপক্ষে দেড় কিলোমিটার দূরের।”
মিয়ানমারের মংডু জেলার বোরগোজবিল এলাকা থেকে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন কালাম। ২৮ বছর ধরে কুতুপালংয়ের নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা কালাম চার সন্তানের জনক।
শিবির ঘিরে ১১১ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া
শরণার্থী শিবির ছেড়ে রোহিঙ্গাদের পালানো ঠেকাতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ক্যাম্পের চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।
পরিকল্পিত মোট ১৪২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বেড়ার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১১১ কিলোমিটার নির্মাণ শেষ হয়েছে বলে বুধবার জানানো হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা বিষয়ক একটি সভায়।
এ তথ্য নিশ্চিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের জ্যৈষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু বেনারকে বলেন, “বাকি অংশ এবছর জুনের মধ্যে শেষ হবে।”
“রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে,” মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের নিরাপদ রাখতে, সুরক্ষা দিতে ও তারা যাতে ক্যাম্পের ভেতরে থাকতে পারে, সেজন্য সরকার ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে।”
“কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ হয়ে গেলে আমরা ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে সংঘটিত অপরাধ দমন করতে পারব। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের পালানো বন্ধ করা যাবে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
“সরকার যদি কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বালুখালী শিবিরের বাসিন্দা শরণার্থী রহমত উল্লাহ।
তিনি বলেন, “কিন্তু সরকারের চিন্তা করা উচিত, আমরা অপরাধী নই, বরং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার শিকার।”
“আমরা বাংলাদেশে থাকতে চাই না। মিয়ানমার সরকার যদি আমাদের নাগরিকত্ব ও বসতবাড়ি ফিরিয়ে দেয়, আমাদের নিরাপত্তা দেয়, আমরা আমাদের দেশে ফিরে যাব,” বলেন রহমত উল্লাহ।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।