দ্বিতীয় দফায় কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর ভাসানচর যাবার জন্য সোমবার শরণার্থী শিবিরে ছেড়েছেন প্রায় এক হাজার আটশ’ রোহিঙ্গা। চট্টগ্রাম হয়ে মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ তাঁরা ভাসানচর পৌঁছাবেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সোমবার দুপুরে ৪২৭টি পরিবারের এক হাজার ৭৭২ জন রোহিঙ্গাকে উখিয়া থেকে ৩০টি বাসে করে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) খোরশেদ আলম খান।
তিনি জানান, “তাঁরা রাতে চট্রগ্রামে থাকবেন।”
চট্টগ্রাম থেকে তাঁদের মঙ্গলবার সকালে “নৌ-বাহিনীর তত্ত্বাবধানে” ভাসানচর নিয়ে যাওয়া হবে বলে বেনারকে জানান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-এর অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোশারফ হোসেন।
“আমরা তাঁদের গ্রহণের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি,” বেনারকে জানান রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমান্ডার এম আনোয়ারুল কবির।
এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় ১,৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় দফার রোহিঙ্গারাও সরকারি ব্যবস্থাপনায় “স্বেচ্ছায়” ভাসানচর যাচ্ছেন বলে সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় জানায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
সরেজমিনে টেকনাফের শামলাপুর শরাণার্থী শিবিরে দেখা যায়, সোমবার সকাল ৮টা থেকে ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রোহিঙ্গারা উখিয়া যাবার জন্য বাসে উঠছেন। এ সময় তাঁদের স্বজনরা দেখতে ভিড় করেন। এবার যারা যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকের স্বজন প্রথম দফায় ভাসানচরে গেছেন।
বিভিন্ন শিবির থেকে আসা রোহিঙ্গারা উখিয়া ট্রানজিট পয়েন্ট ও উখিয়া কলেজের অস্থায়ী ট্রানজিট ঘাটে পৌঁছানোর পর সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুপুরের দিকে বাসে করে চট্টগ্রাম রওয়ানা হন।
প্রথমবারের মতো এবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া পাহারায় ভাসানচরগামী রোহিঙ্গাদের বাসগুলোকে উখিয়া থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়।
‘ভাসানচর উন্নত,’ শুনে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা
ভাসানচরে যারা আছেন, তাঁরা ভালো আছেন শুনে টেকনাফ শামলাপুর শিবিরের বাসিন্দা রাজিয়া বেগম ছোট বোনকে নিয়ে সোমবার সেখানে রওয়ানা দিয়েছেন।
“আমি আর বোন নিজের খুশিতে ভাসানচর যাচ্ছি,” জানিয়ে রাজিয়া বেনারকে বলেন, “এই ক্যাম্প থেকে আরো অনেকে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “ভাসানচরে যারা আছে তারা অনেক ভালো আছে বলে ফোনে জানিয়েছে।”
স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাসানচর যাচ্ছেন একই ক্যাম্পের বাসিন্দা ইমাম হোসেন। সোমবার তিনি বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পে অনেক কষ্টের জীবন। ভাসানচর অনেক ভালো শুনেছি। তাই সেখানে চলে যাচ্ছি।”
“তবে এতদিনের বসবাস করা শিবিরের জন্যও কষ্টে হচ্ছে,” বলেন ইমাম।
পরিবারের আট সদস্য নিয়ে ভাসানচর যাচ্ছেন মো. হোসেন। বাসে বসে হোসেন বেনারকে বলেন, “সেখানে নিরাপত্তাসহ সকল ব্যবস্থা অনেক উন্নত শুনেছি।”
টেকনাফের শামলাপুর শরণার্থী শিবির থেকে পরিবারের সাথে গত ৪ ডিসেম্বর ভাসানচর গেছেন মো. ইসমাইল (১৮)।
সেখান থেকে তিনি ফোনে বেনারকে বলেন, “এখানে আমরা সবাই খুব ভালো আছি। এখানকার পরিবেশ ক্যাম্পের চেয়ে অনেক ভালো।”
“কক্সবাজারের ক্যাম্পে আমার এক বোন রয়েছে। এখন সেও এখানে চলে আসার জন্য বারবার ফোন করছে,” বলেন ইসমাইল।
জাতিসংঘ অবগত নয়
রোহিঙ্গাদের প্রথম দলকে পাঠানোর পর জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনার মধ্যেই সোমবার দ্বিতীয় দলকে পাঠানো হলো।
সোমবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ঢাকা কার্যালয় জানায়, গণমাধ্যম থেকে রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দলকে ভাসানচর পাঠানোর বিষয়ে অবগত হলেও স্থানান্তর প্রক্রিয়ার সাথে তারা সম্পৃক্ত নয়।
“স্থানান্তর প্রক্রিয়ার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা ও গঠনমূলক আলোচনার জন্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে,” বিবৃতিতে বলেন ইউএনএইচসিআর ঢাকা কার্যালয়ের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন।
এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর ভাসানচর বসবাসের উপযোগী কিনা তা যাচাইয়ে জাতিসংঘকে স্বাধীনভাবে সুযোগ না দিয়ে সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার কার্যালয়।
ভাসানচর শরণার্থীদের বসবাসের উপযোগী কি না এবং সেখানে তাঁদের মৌলিক অধিকারের সুযোগ রয়েছে কি না সে বিষয়ে কারিগরি মূল্যায়নের জন্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সরকারকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানানো হয় সোমবারের ইউএনএইচসিআর-এর বিবৃতিতে।
তবে ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ কখনো সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি দেয়নি বলে ডিসেম্বরের শুরুতে বেনারকে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
“তারা (জাতিসংঘ) এ ব্যাপারে মুখে মুখে বলছে, কোনো চিঠি দিয়েছে বলে আমার জানা নেই,” জানিয়ে জাতিসংঘ ভাসানচরে যেতে চাইলে সরকারের কোনো আপত্তি নেই বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে ভাসানচরের বসবাস উপযোগিতা বিষয়ে জাতিংঘের মূল্যায়নের আগে আর কোনো রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর না করার জন্য গত ২৩ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংক্রান্ত বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সিনেটর বেন কার্ডিন।
এছাড়া গত ২১ ডিসেম্বর উত্তর আমেরিকার ইমাম ও মুসলিম নেতারা অবিলম্বে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠান।
তবে দ্বিতীয় দলে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গার ভাসানচর যাওয়াকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বাংলাদেশের বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এহসানুল হক বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাচ্ছেন, মানে প্রমাণ হলো যে, সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কারণ, তাঁরা কক্সবাজারের শিবিরে অত্যন্ত ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছেন।”
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আগে আশ্রয় নেওয়াসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছেন।
কক্সবাজার থেকে শরণার্থীদের চাপ কমাতে দুই বছর আগে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে নোয়াখালীর হাতিয়ার কাছে মেঘনা নদীর মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নৌবাহিনীর তত্বাবধানে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
ডিসেম্বরের শুরুতে কক্সবাজার থেকে প্রথম দল রোহিঙ্গা যাবার আগেই সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে ধরা পড়া ৩০৬ জন রোহিঙ্গা গত মে মাস থেকে ভাসানচরে রয়েছেন।
ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।