নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) এক আঞ্চলিক কমান্ডারসহ দুইজনকে বুধবার রাজশাহীতে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আস্তানা ধ্বংসে দুদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যৌথভাবে অভিযান চালাবে বলে একই দিনে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
হুজি-বি সদস্যদের মতিহার থানার খড়খড়ি বাইপাস এলাকা থেকে বুধবার সকালে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া ) মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস।
আটকরা হলেন হরকাতুল জিহাদের রাজশাহী-খুলনার আঞ্চলিক কমান্ডার মুফতি ইব্রাহিম খলিল (৪১) এবং সংগঠনের সমন্বয়কারী আবদুল আজিজ ওরফে নোমান (২৩)।
পুলিশ জানায়, ইব্রাহিমের বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায় এবং নোমানের বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে। গ্রেপ্তারের সময় তাঁদের কাছে বিপুলসংখ্যক জিহাদি বই পাওয়া গেছে বলেও জানায় পুলিশ।
বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে আরএমপি কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, “গ্রেপ্তারকৃতদের সাথে আরো চারজন ছিল, যারা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে গেছে।”
তাঁদেরকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে বলেও জানান তিনি।
এর আগে সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব)।
কারাবন্দির নির্দেশে সক্রিয় হুজি-বি
গ্রেপ্তার দুই জঙ্গির প্রসঙ্গে আরএমপি কমিশনার বলেন, “তাঁরা গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে থাকা হুজি-বি নেতা আতিকুল্লাহ ওরফে জুলফিকারের নির্দেশনায় সংগঠনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন।”
আতিকুল্লাহ আলোচিত হুজি-বি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের অন্যতম সহযোগী ছিলেন উল্লেখ করে কমিশনার জানান, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা টাকা দিয়ে হুজি-বির কারাবন্দি সদস্যদের জামিন করানোর চেষ্টা চলছে।
একাধিক অপরাধের জন্য ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জঙ্গিনেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে হুজি-বির যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, তাতে সাংগাঠনিক সম্পাদক ছিলেন আতিকুল্লাহ। পরবর্তীতে তিনি সংগঠনের বায়তুল মাল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্ব পান।
গত বছরের অক্টোবরে তাঁকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) এক কর্মকর্তা বেনারকে জানান, আশির দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেন আতিকুল্লাহ। তখন থেকেই ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমর বা জাওয়াহেরির মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গিনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুবাই হয়ে সৌদি আরব গিয়ে আত্মগোপনে থাকাকালীন তিনি একাধিকবার পাকিস্তানে গিয়ে জঙ্গিনেতাদের সাথে বৈঠক করেন। তাঁদের পরামর্শেই হুজি-বি পুনরায় সচল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গত বছরের মার্চে তিনি দেশে ফিরেছিলেন বলেও জানিয়েছিল সিসিটিসি।
জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্র ইসলামি সংগঠন হিসেবে হুজি-বিকে ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ করে সরকার।
“জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ নয়, বরং নির্মূলের বিষয়। কিন্তু সেদিকে আমরা নজর দিচ্ছি না,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক।
“এই মানসিকতার ‘পুলিশিং’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত যৌথ উদ্যোগ দরকার।”
তাঁর মতে, “বাংলাদেশের জঙ্গিরা এখনও সুযোগ এবং সময়ের অপেক্ষা করে আছে। যখন পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে, তখনই তারা বেরিয়ে আসে। বহু জঙ্গিনেতা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।”
মিজোরামে যৌথ অভিযান চালাবে বিজিবি-বিএসএফ
ভারতের মিজোরাম রাজ্যের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সশস্ত্র আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আস্তানা ধ্বংসে দুদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবি যৌথভাবে অভিযান চালাবে বলে বুধবার পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের মধ্যে পদক বিতরণ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
মিজোরাম রাজ্য লাগোয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা ঠেকাতে বর্ডার আউটপোস্ট (বিওপি) বাড়ানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
“সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসী গ্রুপ আছে। তাদের ধাওয়া দিলে দুর্গম এলাকা দিয়ে পালিয়ে যায়। এজন্য বিওপির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে কবে থেকে যৌথ অভিযান শুরু হবে বা কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান।
“সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিষয়টা দুই দেশেরই কমন ইস্যু,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে। আমরা ধারণা করছি, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তে ভারতের অংশে আস্তানা নিয়ে রাখতে পারে।”
আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দমনে গত সপ্তায় আসামে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সম্মেলনে এই যৌথ অভিযানের প্রস্তাব আসে জানিয়ে কর্নেল ফয়জুর বলেন, “তবে কোনো কিছু এখনো চূড়ান্ত হয়নি।”
সন্ত্রাস দমনে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা ইতিবাচক বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী।
তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় যদি কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লিপ্ত হয় এবং তারা যদি মিজোরামে আশ্রয় নেয় তাহলে ভারত সরকারের উচিত তাদেরকে উচ্ছেদ করা। দুইদেশ আন্তরিকভাবে অভিযান চালালে সেটা কার্যকর হবে,” বলেন ইশফাক ইলাহী।
এর আগে গত ২৬ ডিসেম্বর শেষ হওয়া দুদেশের মধ্যকার চারদিনব্যাপী বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনে বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নজরে এনে সন্ত্রাসী আস্তানাগুলো ধ্বংস করার জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ।
সীমান্ত সুরক্ষায় যৌথ টহলদারির বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হয়েছে বলে সীমান্ত সম্মেলন শেষে বিএসএফের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
তবে ভারতীয় ভূখণ্ডে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশি সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করতে বিএসএফের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালানো প্রসঙ্গে বিজিবির প্রস্তাব নিয়ে বিএসএফের সংশ্লিষ্ট ফ্রন্টিয়ারের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল।