কক্সবাজারের এক রোহিঙ্গা শিবিরে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে সাড়ে পাঁচশ’র বেশি ঘর। বৃহস্পতিবার ভোরে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় কেউ নিহত না হলেও অন্তত ১৪ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এতে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের ৫৫২টি ‘শেল্টার’ পুড়ে যাওয়ায় তিন হাজারের মতো শরণার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন।
তবে ওই শিবির থেকে সাড়ে তিন হাজার শরণার্থী বাস্তুচ্যুত হয়েছেন বলে এক বিবৃতিতে জানায় কক্সবাজারে সহায়তা সংস্থাগুলোর সমন্বিত সংগঠন ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)।
আগুনে বাড়িঘরের পাশাপাশি দেড়শ’টি দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে টুইট বার্তায় দাবি করে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)।
“কয়েক বছর ধরে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য এটি আরেকটি বিধ্বংসী আঘাত,” বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের পরিচালক ওন্নো ভ্যান মানেন।
শিবিরের ঘরগুলো একটি আরেকটির লাগোয়া হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে বেনারকে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল্লাহ।
তাঁদের তিনটি ইউনিট প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় জানিয়ে তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনো উদঘাটিত হয়নি, তদন্তের পর বলা যাবে।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডে আহত ১৪ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে নয়াপাড়া ক্যাম্পের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক চন্দ্রিমা সেন বেনারকে বলেন, “তাঁদের কারো অবস্থাই তেমন গুরুতর নয়।”
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার শিবিরে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে গৃহস্থালির বেশিরভাগই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারপরও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কিছু টিকে আছে কিনা খুঁজছেন কেউ কেউ।
“ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে” বেনারকে জানান নয়াপাড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ (সিআইসি) আব্দুল হান্নান।
এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের শিবিরের স্কুলে আশ্রয় দিয়ে খাবার ও অন্যান্য পরিষেবা সরবরাহ করা হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বরাত দিয়ে এক বিবৃতিতে জানায় ইউরোপিয়ান সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিটেরিয়ান অপারেশন্স (ইসিএইচও)।
একটি গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে দাবি করেছে ইসিএইচও।
উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ২০১৭ সালের আগস্টের পর কমপক্ষে ২৫টি বড়ো অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। এর মধ্যে গত বছরের মে মাসে কুতুপাংলয়ে এক অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গিয়েছিল প্রায় চারশ’ ঘর।
“গত বছর কুতুপালং অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নি নিরাপত্তা বাড়াতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ক্যাম্পগুলো ‘ফায়ার পোস্ট’ স্থাপন করা হয়েছে, অগ্নি নির্বাপণী মহড়া করা হয়েছে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে সেচ্ছাসেবীদের। যে কারণে অনেক দিন কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি,” বলেন অতিরিক্ত আরআরআরসি মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা।
তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা আবদুল্লাহ বলেন, “নতুন ক্যাম্পগুলোতে এ জাতীয় কর্মকাণ্ড করা হলেও পুরানো নিবন্ধিত ক্যাম্পে তা করা হয়নি। যে কারণে সেখানে সচেতনতায় ঘাটতি রয়েছে। সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণেও আমাদের বেগ পেতে হয়েছে।”
ডাকাত দলকে দুষছেন রোহিঙ্গারা
ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা জানান, রাত আড়াইটার দিকে ক্যাম্পের ই-ব্লকের বাসিন্দা মাবিয়া খাতুনের ঘর থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।
মাবিয়া বেনারকে বলেন, “আমার ঘরে কোনো বিদ্যুৎ বা গ্যাসের রান্নার চুলা ছিল না। ডাকাত দলের সদস্যরা শত্রুতার জেরে আমাদের হত্যার উদ্দেশে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের হয়ত ধারণা ছিল না এত বড় ঘটনা ঘটে যাবে।”
এর আগে ওই ডাকাতরা এই ক্যাম্প থেকে তাঁদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছিল বলেও জানান তিনি।
মাবিয়ার ছেলে শওকত আলীকে দলে যোগ দেওয়ার জন্য একটি রোহিঙ্গা ডাকাত দল চাপ দিয়ে আসছিল বলে জানান শরণার্থীরা।
ওই পরিবারটিকে ডাকাতদের হুমকি দেওয়ার ঘটনাটি জানেন জানিয়ে মাবিয়ার প্রতিবেশী আজিম উল্লাহ বেনারকে বলেন “অতি দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার থাকায় তা বিস্ফোরিত হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।”
“ডাকাত দলের লোকজন আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আমাদের কানেও এসেছে,” জানিয়ে ওই শিবিরে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ মো. আব্দুল্লাহ বিন কালাম বেনারকে বলেন, “তবে যাচাই-বাছাই না করে এটা সত্য কিনা বলা যাবে না।”