Skip to content

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালের নির্যাতনকে ‘গণহত্যা’ বলে ঘোষণা করল যুক্তরাষ্ট্র

বেনার নিউজ:

পাঁচ বছর আগে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানকে ‘গণহত্যা’ বলে সোমবার ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া সেই অভিযানে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’র হলোকস্ট মেমোরিয়াল যাদুঘরে অনুষ্ঠিত “বার্মার গণহত্যার নীলনকশা” শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন

যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্তের উপনীত হয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর ‘আটবার গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে,” জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন বলেন, “আমি নিশ্চিত বার্মার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও মানবতাবিরুদ্ধ অপরাধ করেছে।”

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’র হলোকস্ট মেমোরিয়াল যাদুঘরে ‘বার্মার গণহত্যার নীলনকশা’ শীর্ষক প্রদর্শনী দেখার পর বক্তব্য রাখছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। ২১ মার্চ ২০২২। [এএফপি]

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আসবে

বাংলাদেশ সরকার, মানবাধিকার সংগঠন, মার্কিন আইন প্রণেতা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দায়ী কর্মকর্তাদের অনেক আগেই বিচারের সম্মুখীন করা উচিত ছিল।

মার্কিন সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সোমবার বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে গণহত্যাসহ যে বিভিন্ন ধরনের অমানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে সেগুলো আন্তর্জাতিক মহলসহ সকলের জানা উচিত।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমারে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে—মার্কিন সরকারের এই ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমেরিকা সরকারের এই ঘোষণার ফলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে এবং তাঁদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আসবে।”

যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মানবাধিকার কর্মী তুন খিন বলেন, মার্কিন সরকারের এই ঘোষণা গতবছর সেদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণকারী মিয়ানমার সেনা-নেতৃত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

তিনি বলেন, ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে ক্রমশ রক্তপাত চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সেনা সরকার।

বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে তুন খিন বলেন, “গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে—মার্কিন এই সিদ্ধান্তের ফলে সেদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ চাপিয়ে দেয়া সেনা সরকারের কার্যক্রমই শুধু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে না। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গারা বুঝবেন, তারা যে নিদারুণ কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন সেগুলোর প্রতি নজর রয়েছে।”

“এর ফলে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গারা কীভাবে বসবাস করছেন সেব্যাপারে আন্তর্জাতিক নজরদারি বৃদ্ধি পাবে এবং কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেদের জনগণের ওপর পরিচালিত সহিংসতা বন্ধে ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আচরণ পরিবর্তন করতে ভূমিকা রাখবে,” বলেন তুন খিন।

জাতিসংঘ তদন্ত কর্মকর্তারা ২০১৮ সালে জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী “গণহত্যার উদ্দেশ্যে” মুসলিম রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে হত্যা এবং রোহিঙ্গা নারীদের গণধর্ষণ করেছে।

বেসরকারি সংগঠন ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস’র হিসাবে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক অভিযানে কমপক্ষে ছয় হাজার ৭০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ঘোষণার আগ পর্যন্ত মার্কিন সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নিধন’ সংগঠিত হয়েছে বলে মতামত দিলেও আন্তর্জাতিক আইনে চরম মাত্রার অপরাধ হিসাবে গণ্য ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা থেকে দেশটি বিরত থাকে।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত গণহত্যা সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধ এবং এর বিচার সংক্রান্ত আইন “ইউনাইটেড নেশান্স কনভেনশন অন দি প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব জেনোসাইড” অনুযায়ী গণহত্যার অর্থ হলো কোনো জাতি, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী অথবা ধর্মীয় মানুষকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সংগঠিত অপরাধ।

মিয়ানমারে নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে দেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের পালংখালী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন রোহিঙ্গারা। ২ নভেম্বর ২০১৭। [রয়টার্স]
মিয়ানমারে নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে দেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের পালংখালী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন রোহিঙ্গারা। ২ নভেম্বর ২০১৭। [রয়টার্স]

গভীর অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল জো বাইডেন সরকারের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে।

এই ঘোষণাকে “গভীর অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ,” হিসেবে আখ্যায়িত করে সংগঠনটির আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপপরিচালক ড্যানিয়েল সালিভান এক বিবৃতিতে বলেন, “আজকের দিন পর্যন্ত যেসকল জাতি-গোষ্ঠী সামরিক সরকারের হাতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তাদের জন্য এই ঘোষণা মার্কিন সরকারের দৃঢ় প্রত্যয় বলা যায়।”

২০১৭ সালে উত্তর রাখাইন রাজ্যে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর হামলার জবাবে রোহিঙ্গা এলাকাগুলোতে নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করে সেদেশের সেনাবাহিনী।

এর ফলে কয়েকদিনের মধ্যে রাখাইন রাজ্য থেকে সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য করা হয়। সেসময় ক্ষমতাসীন অং সান সূচি সরকার ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই অভিযানকে “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” বলে অভিহিত করে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তদন্ত দলের সদস্য ও পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল ‘ল’ অ্যান্ড পলিসি গ্রুপের ড্যানিয়েল ফুলারটন জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে পরিচালিত সামরিক অভিযানের আগের বছর ও মাসগুলোতে রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে থাকে।

গতবছরে মে মাসে মার্কিন সরকারের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক শুনানিতে তিনি বলেন, “আমরা সকল উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখেছি ২০১৭ সালের বড়ো আকারের আক্রমণের আগে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বছরওয়ারি সহিংস ঘটনার সংখ্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।”

ড্যানিয়েল বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটনার মধ্যে ছিল ব্যাপক হারে লাঞ্ছনা, নির্বিচার গুলি, ফাঁসি, ঝুলিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, প্রহার, অঙ্গহানি, শিশুদের আগুনে ও পানিতে নিক্ষেপ করে হত্যা, বাড়িঘর ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, ইত্যাদি।

“যদিও এই ঘোষণা আগেই দেয়া উচিত ছিল। তবুও এই নিষ্ঠুর সরকারকে জবাবদিহি করতে এটি একটি শক্তিশালী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত,” এক বিবৃতিতে বলেন ডেমোক্র্যাট দলীয় অরিজন রাজ্যের সিনেটর জেফ মার্কলি।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা বিতাড়নের পর মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধি হিসাবে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর করেন মার্কলি।

ওই সফরকে স্মরণ করে তিনি বলেন, “বার্মার সামরিক জান্তা গণহত্যা পরিচালনা করেছে এমন ধারণা নিয়েই আমি ওই সফর শেষ করি এবং আমার মনে হয়েছিল যে মার্কিন সরকারের উচিত এই কাজকে গণহত্যা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া।”

এই ধরনের ঘটনা যেখানেই ঘটুক না কেন সেগুলো দৃষ্টিগোচর করে সেগুলো বন্ধ করতে আমেরিকাকে বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে হবে, মন্তব্য করে মার্কলি বলেন, মারাত্মক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আমেরিকার কখনও নিশ্চুপ থাকা উচিত নয়।

“আমেরিকারে নিশ্চিত করতে হবে, বিশ্বের যে কোনো স্থানে কোনো সরকার যদি তার জনগণের ওপর পদ্ধতিগতভাবে নিপীড়ন চালায় এবং জনগণের মানবাধিকার কেড়ে নেয় তাহলে সেই সরকারকে এই কাজের জন্য ফলাফল ভোগ করতে হবে,” বলেন তিনি।

নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গাদের জন্য ইতিবাচক

বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের শূন্য রেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা দীল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন আসলেই একটি গণহত্যা। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টি বিশ্বাস করলেও এতদিন প্রকাশ করেনি।”

তিনি বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি “নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গাদের জন্য ইতিবাচক।”

“আমরা চাই শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোও রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলুক। এতে করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সহজ হবে,” বলেন এই রোহিঙ্গা নেতা।

তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সোচ্চার হলে আন্তর্জাতিক আদালত বিষয়টি আমলে নিতে পারে। ফলে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী গণহত্যার মতো অপরাধের বিচার পাবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলে আসা নির্যাতন নিপীড়ন বন্ধ হবে। এবং নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরার পথ সুগম হবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাশে থাকলে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় রোহিঙ্গারা অবশ্যই ন্যায় বিচার পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর সেক্রেটারি মোহাম্মদ জুবায়ের।

যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে থাকলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং মগদের এই জঘন্য অপরাধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে।”

প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী এবং কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *